Wednesday, April 22, 2015

তাহলে রিঙ্গিত দেন!

রফিকুল ইসলাম সাগর
কুয়ালামপুর থেকে ঢাকায় আসব৷ সেদিন ছিল খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড় দিন। ইউনাইটেড এয়ারলাইনসে সকাল ছয়টায় ফ্লাইট। কুয়ালামপুরে আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে বিমানবন্দর বেশ দূরে। তাই এক বন্ধুর গাড়িতে বুকিট বিনতাং এলাম। সেখানে পৌঁছলাম রাত ১২টার কয়েক মিনিট আগে। ওই এলাকায় সেদিন অন্যদিনের তুলনায় পর্যটকদের আনাগোনা কয়েক গুণ বেশি আর উৎসবমুখর পরিবেশ। হোটেল, রেস্তোরাঁ, বার ও ডিস্কোগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সর্বত্র আকর্ষণ করার মতো লাইটিং। চলছে গান–বাজনা। কোথাও কোথাও লাইভ কনসার্ট হচ্ছিল। এসব অনুষ্ঠানে বলিউড ও হলিউডের জনপ্রিয় শিল্পীরা উপস্থিত। আমরা এক বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি রেস্তোরাঁয় গেলাম। সেখানে ভারত ও নেপালি শিল্পীদের নাচগান উপভোগ করলাম।
এ আনন্দ উৎসবে সময় যে কীভাবে অতিক্রম হয়েছে, টের পাইনি। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত তিনটা। আমার মাথায় ফ্লাইটের চিন্তা আটকে গেল। বন্ধুকে বললাম, উঠতে হবে। বন্ধু আর পাঁচ-দশ করে আধঘণ্টা পর উঠল। সাড়ে তিনটায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে অবিশ্বাস্য যানজট দেখে আমার বুক ধুকধুক করতে শুরু করল। ঠিক সময়ে পৌঁছেতে না পারলে ফ্লাইট মিস হবে। সামনের দিকে যত দূর চোখ যায় দেখলাম সামনে শুধু সারি সারি গাড়ি। দেখে মনে হলো, গোটা কুয়ালামপুরের মানুষ যেন এখানে এসেছে উৎসব করতে। রাস্তার পাশে আতশবাজির কাগজের স্তূপ।


একটু একটু করে এগোচ্ছিল গাড়ি। বন্ধু আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘নির্ধারিত সময়েই বিমানবন্দরে পৌঁছব। জ্যাম ছুটলে পৌঁছতে সময় লাগবে ৪০ মিনিট। আমাদের হাতে এখনো অনেক সময় আছে।’ বন্ধুর কথায় আমার মন সান্ত্বনা পেল না। তবে মাত্র ২০ মিনিটেই সেখানকার ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল। এতে অবাকই হলাম। মনে মনে ট্রাফিক পুলিশদের স্যালুট দিলাম। বন্ধু যতটা দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দরে পৌঁছালাম একেবারে কাঁটায় কাঁটায় সময় হাতে থাকতে। কাউন্টারের যখন দাঁড়ালাম, তখন ছয়টা বাজতে ৫০ মিনিট বাকি। আমি একা। ততক্ষণে সব যাত্রী বোর্ডিং পাস নিয়ে ভেতরে চলে গেছে। আমিই শেষ যাত্রী। কাউন্টারে যিনি ছিলেন, তাঁর হাতে ভয়ে ভয়ে টিকিটটি দেওয়ার পর তিনি আমার লাগেজ গ্রহণ করলেন। এরপর নিশ্চিন্ত হলাম। জানতে পারলাম, আর ১০ মিনিট দেরি হলে কাউন্টার বন্ধ হয়ে যেত।
ইমিগ্রেশন শেষ করে জানলাম, ফ্লাইট তিন ঘণ্ট ডিলে। বাংলাদেশের আকাশে কুয়াশার কারণে ছয়টার পরিবর্তে নয়টায় রওনা হবে। মালয়েশিয়ার কেএলআই (কুয়ালামপুর আন্তর্জাতিক) বিমানবন্দরটি আয়তনে বিশাল। যদি ভেতরে সুস্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনা না দেওয়া থাকত, তাহলে বাইরে বের হওয়াটা পর্যটকদের জন্য মুশকিলই হতো। ভেতরে আকর্ষণীয় ঝকঝকে পরিবেশ। বিমানবন্দরটি পর পর তিনবার ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে বিশ্বের সেরা বিমানবন্দরের মর্যাদা অর্জন করেছে। আমাদের হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ে একটি। আর এ বিমানবন্দরের রানওয়ে তিনটি।


বিমান নয়টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলো। ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। ইমিগ্রেশনের সামনে বিশাল লাইন। সেদিন শুধু আমাদের ফ্লাইট ডিলে হয়নি। প্রায় সব ফ্লাইটই কুয়াশার কারণে ডিলে হয়েছে। ফলে ইমিগ্রেশনে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে লক্ষ করলাম, ইমিগ্রেশনের কয়েকটি কাউন্টার বন্ধ। সবকটি কাউন্টার ব্যবহার হলে যাত্রীদের সময় একটু কম নষ্ট হতো।
ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে খুব বির​ক্তি অনুভব করছিলাম। দুই ঘণ্টার বেশি সময় পর ইমিগ্রেশনের ঝুট ঝামেলা পেরিয়ে বের হওয়ার পর দুজন এসে বলল, ‘দাঁড়ান! লাগেজটা স্ক্যান মেশিনে দেন।’ আবার চেকের নামে সময় নষ্ট হলো। সবশেষে বাইরের পা রাখতেই শুরু হলো ফকিরদের উৎপাত। তাদের বললাম, ‘আমার কাছে বাংলাদেশি টাকা নেই।’ তারা বলে, ‘তাহলে রিঙ্গিত দেন!’ ফকিরের এমন কথায় অবাকই হলাম। পরে জানলাম বিমানবন্দরের ভিক্ষুকেরা কোন ফ্লাইট কখন অবতরণ করে, সব খোঁজখবর রাখে।
লেখা ও ছবি : রফিকুল ইসলাম সাগর
কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া


প্রথম আলো-তে প্রকাশিত (ডিসেম্বর ০৩, ২০১৪)

No comments:

Post a Comment