Wednesday, April 22, 2015

ভয়ংকরএক রাতের গল্প

-রফিকুল ইসলাম সাগর

এক.
বড় ভাইয়ের সাথে প্রচন্ড রকমের ঝগড়া হয়েছে। মন খারাপ করে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। আজ আর বাড়ি ফিরে যাবনা। কিন্তু কোথায় যাব? এই মুহুর্তে কোনো  গৌন্তব্যের ঠিকানা মনে পড়ছে না। বন্ধু আবু তাহেরদের বাড়িতে গিয়ে থাকব কিছুদিন? নাহ! ওদের ওখানে যাওয়া যাবে না। তাহেরদের বাড়ি আমাদের পরিবারের সবাই চিনে। আমাকে খুঁজে পাওয়া না গেলে সর্বপ্রথম ওদের ওখানেই গিয়ে খোঁজ করা হবে। এবার এত সহজে আমাকে খুঁজে বের করতে দেয়া যাবেনা। এমন জায়গায় যেতে হবে  যেখান থেকে আমাকে সহজে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাহলে  কোথায় যাবো? সবেমাত্র সন্ধ্যা। এখনো হয়তো আমাকে নিয়ে কারো চিন্তা হচ্ছে না। রাতে বাড়ি না ফিরলেই বাবা-মা আমাকে নিয়ে চিন্তা শুরু করবে। খোঁজা শুরু হয়ে যাবে। করুক গিয়া চিন্তা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে সায়দাবাদের বাসে উঠে গেলাম।
দুই.
সায়দাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে মনে পড়ল আমার এক দূর সম্পর্কের চাচা থাকে কুমিল্লা। ঠিক করলাম কুমিল্লা চলে যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। উঠে পড়লাম একটি বাসে। তার ওখানে গেলে কেউ ধারণা করবে না আমি সেখানে গিয়েছি। চাচা দূর সম্পর্কের হলেও আমার বাবার সাথে তার অনেক ভালো সম্পর্ক। মাঝে মাঝে তিনি ব্যবসার কাজে ঢাকা এলে আমাদের বাড়িতেই থাকেন। আমাকেও খুব আদর করেন। চাচার নাম হামিদ। প্রায়ই তিনি তাদের বাড়িতে আমাকে যেতে বলতেন। চার-পাঁচ বছর আগে একবার বাবা-মায়ের সাথে হামিদ চাচার বাড়িতে গিয়েছিলাম। চলতি বাসের ভিতরে বসে বসে মনে করে নিচ্ছিলাম হামিদ চাচার বাড়িতে তখন কিভাবে গিয়েছিলাম।  কোন রাস্তায় নেমে কিভাবে কিভাবে যেতে হবে পার্ট বাই পার্ট আমার চোখে ভেসে উঠছিল। বাস থেকে কুমিল্লা বিশ্বরোড নেমে তারপর কান্দিরপাড় এরপর কালীবাজার। চলতি পথে বাসের চাকা পাংচার হয়ে যাওয়াতে বাস থেমে  গেল। হেলপার বলল, সবাই নামেন চাকা পাংচার হইয়্যা  গেছে। ঠিক হইতে সময় লাগব। এক্সট্রা চাকা নাই সামনে দুই কিলোমিটার দুরে একটা গাড়ির গ্যারেজ আছে। ওইখান থেইকা চাকা সারায়া আনতে হইব। হেলপারের এই কথায় ক’জন যাত্রী হইচই শুরু করে দেয়। চরম উত্তেজিত কন্ঠে একজনকে বলতে শুনলাম, ওই মিঞা কি গাড়ি নিয়া রাস্তায় বাইর হও যে এক্সট্রা চাকা নাই? তার সাথে সাথে আরো কয়েকজন যোগ দেয়। কেউ কেউ বাসের চালককে জায়গায় বসেই মুখে মুখে লাঠি-উষ্ঠা ও থাপ্পর দিচ্ছে। চালক করুন সুরে উত্তেজিত যাত্রীদের শান্ত করতে বলল, কি করমু কন আজকেই দুই দুইবার চাকা পাংচার হইছে। আরেকটা চাকা টার্মিনালে সারাইতে রাইখা আসছি। শান্ত হয়ে একে একে সবাই বাস থেকে নেমে পড়ল। আমি নামলাম সবার শেষে।
তিন.
আসে পাশে কোনো ঘর-বাড়ি নেই। আলো নেই। অন্ধকার আর অন্ধকার। পথের দুই পাশটায় অনেক বড় বড় কড়ই গাছ। উপরের দিকে তাকিয়ে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায়। মেঘে ঢাকা পড়ে মনে হচ্ছে চাঁদবিহীন আকাশ। আকাশটাকে খুব ভয়ংকর দেখাচ্ছে। আমার সামনে পিছনে পথ। বামে ডানে যতদূর চোখ যায় ধান  ক্ষেত। ক’টি বাঁশঝাড় চোখে পড়ছে। এমন অবস্থায় আমার খুব ভালো লাগছে। বাস যখন ইচ্ছা ছাড়ুক আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে শুরু করলাম। এদিকে দুইজন হেলপার বাসের চাকা খোলার কাজে ব্যস্ত। বাসের কন্ডাক্টর লাইট ধরে রেখে তাদের দু’জনকে আলো দিয়ে সাহায্য করছে। চালককে কোথাও  দেখা যাচ্ছে না। আমি কন্ডাক্টরকে প্রশ্ন করলাম, মামা কতক্ষণ সময় লাগতে পারে? দুই ঘন্টার মতো লাগব, উত্তর  দেয় কন্ডাক্টর। আর বেশি কথা বললাম না। পিচঢালা পথ  থেকে নেমে ধান ক্ষেতের আকা-বাঁকা মাটির পথে হেটে সামনের দিকে যেতে থাকি। হাটতে হাটতে অনেকটা সামনে এগিয়ে যাই একা একা। একটা বাঁশঝাড়ের সামনে গিয়ে থামি। ভয়ংকর একটা বাঁশঝাড়। সামনে বড় মাটির পথ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সে পথে মানুষের চলাচল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পথের শুরুতে একটা গাছ। অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝা যায় না কি গাছ। মনে হয় বট গাছ। গাছের ডালে সাদা কি যেন একটা দেখা যায়। হটাৎ ভয় পেয়ে যাই। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কাউকে  দেখা যাচ্ছে না।
বাসটাও না। ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর ব্যাঙ ডাকছে। আমার গায়ের  লোম শিউরে উঠে। আবার তাকাই গাছটার দিকে। এখন সাদা জিনিসটা অন্য ডালে দেখা যাচ্ছে। কি ওটা রহস্য জানার কৌতুহল চেপে যায় আমার। এটা তো পাখি না। পাখিতো এতো বড় হয়না। একবার মনে হলো জ্বিন ভুত নাকি? হলেও হতে পারে জ্বিন ভূতরা নাকি গাছে থাকে, এটা  ভেবে খুব ভয় এসে যায়। থমথমে পরিবেশ। গভীর ভাবে  সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলাম এদিকে বাঁশঝাড়ের ভিতর থেকে আমাকে কে যেন ডাকে। আমি জবাব দেই, কে কে? এবার উচ্চ সুরে হাসির শব্দ। গতি বাড়িয়ে আমি উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম।জোরে জোরে সূরা পড়া শুরু করলাম। আমি অনেকটা দূরে চলে এসেছি।
চার.
পথ হারিয়ে ফেলেছি। প্রতি দমে কদমে পা কাঁপছে।  কোনদিকে যাবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। মাথা ভার হয়ে আসছে। খুব কান্নাও পাচ্ছে। ঠান্ডা আবহাওয়াতেও আমার শরীরের ঘাম ঝড়ছে। সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে হেঁটেই চলছিলাম। হটাৎ দেখি আমার সামনে একটি মেয়ে হাঁটছে। চুল গুলো অনেক বড় বড়। কালো জামা পড়া। এতো রাতে  মেয়ে মানুষ? এতক্ষণ তো আমার সামনে কেউ ছিলনা, এমন ভাবনা মনে এলেও আবার সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নেই। পথে কাউকে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাই। কিছু না বলে আমি তার পিছন পিছন হাটতে থাকি। তাকে ডাকলে যদি ভয় পায়। মেয়ে মানুষ বলে কথা। তার পিছন পিছন গেলে ঠিকই পথ পেয়ে যাবো এ ভেবে তার পিছনে হাঁটতে থাকি।  মেয়েটির পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে একটি শশানের  গেইটের সামনে চলে গিয়ে আমার ঘটকা লাগে। এইবার পিছন থেকে বললাম, এই যে শুনুন! বাস চলাচলের রাস্তাটা কোন দিকে বলতে পারেন? এ কথা বলার সাথে সাথে  মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমার শরীরে কে যেন ইটের টুকরা ছুড়ে মারে আমি সূরা পড়তে পড়তে দিলাম দৌড়। একটু দূরে বাসটি দেখা যাচ্ছে। অনান্য যাত্রীদের দেখা যাচ্ছে। আমি  যেন প্রাণ ফিরে  পেলাম। সাহস পাই। একটা সিগারেট জ্বালালাম। সিগারেট টানতে টানতে বাসের কাছে চলে এলাম। কাউকে কিছু বললাম না। আমার হাতে ঘড়ি নেই। ক’টা বাজে জানা প্রয়োজন। আমার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছি। অন করলেই আব্বার ফোন আসবে। তাই আর মোবাইল অন করে ক’টা বাজে দেখলাম না। চাকা সারিয়ে আনা হয়েছে। এখন শুধু লাগানো বাকি। বাস ছাড়তে অল্প কিছুক্ষণ লাগবে। কন্ডাক্টর-এর ডাক পড়ল, সবাই উঠেন চাকা লাগানো হইছে। এখনই বাস ছাড়ব।
পাঁচ.
বাস চলছে। জানালার পাশের সিটে বসে আমি। হেলপারের কন্ঠে শুনতে পেলাম, যারা বিশ্বরোড নামবেন গেটে আহেন। আমি অতি আগ্রহে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। বিশ্বরোড নামতে হবে। বাস থামল।
-বিশ্বরোড নামেন।
বাইরে তাকিয়ে দেখি বাবা-মায়ের সাথে যখন হামিদ চাচার বাসায় এসেছিলাম এখানেই নেমেছিলাম বলে মনে পড়ছে। তারাহরা করে সিট থেকে উঠে উচ্চ সুরে বললাম, ঐ আমি এখানে নামমু। বাস থেকে নেমে একটি দোকানে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১২টা ছুই ছুই। পেটে খুদা থাকলেও কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। ঢাকা শহরে বেবি অটোরিক্সা চলাচল বন্ধ হলেও গ্রামে এখনো বেবি চলে। একজন বেবি অটোরিক্সা চালককে বললাম, মামা কালীবাজার যাবেন? সে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, এতো রাইতে ওই পথে যাইবেন। ওই পথে তো এখন কোনো গাড়ি যাইবনা। আমি তার কথায় গুরুত্ব দিলাম না। অন্য আরেকজন চালককে বললাম। সেও আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, এতো রাইতে ওই পথে কেউ যাইবনা। একজন ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, আপনি কই যাইবেন?
-কালীবাজার যাব।
-সেখানে কার বাড়ি যাবেন?
-হামিদ চাচার বাড়ি। আপনি চিনেন?
-নাহ! চিনি না। আপনি এখন ওই পথে না যাওয়াই ভালো। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।
-কেন? এখন গেলে কি সমস্যা?
-ওই পথটা অনেক খারাপ। রাতে ওই পথে জ্বিন ভুত চলাচল করে। মাঝে মাঝে গলাকাটা ছাগল, গলাকাটা মানুষ হাটতে  দেখা যায়। আবার ডাকাতেরও আনাগোনা।
আমি তার এসব কথায় খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না। হেঁটেই হামিদ চাচার বাড়ি যাওয়া ধরলাম। একটার পর একটা সিগারেট টানতে টানতে হাঁটছি। খুব ভয়ংকর পথ। আসে পাশে জনবসতি একেবারেই নেই। শিয়াল ডাকছে। আমার মনে ভয় ঢুকে গেল। এখন পিছে ফিরে যাব নাহ! যা হওয়ার হবে, এমন ভেবে ভেবে পথ চলতে থাকলাম। প্রায় দুই কিলোমিটার হেটে এবার পথ গিয়েছে উঁচু পাহাড়ে। দুই পাশে গভীর জঙ্গল। আমার সিগারেট একটার পর একটা জ্বলছে।
ছয়.
আমার পথের সামনে দিয়ে একটা অনেক বড় গলাকাটা বিড়াল হেটে গেল। ভয়ে হাত পা আবার কাপাকাপি শুরু হয়। তবে নিজেকে নিজে সাহস দিচ্ছিলাম। হাতের মুঠোয় ম্যাচ ধরে রাখলাম। পাহাড়ের উঁচুতে গিয়ে আবার নিচের দিকে পথ গিয়েছে। পায়ের গতি বেড়ে যায়। পথে আমার সামনে একটা সাদা-কাপড় পরিহিত একজন দাঁড়ায়। আমি তার দিকে তাকিয়ে তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। মাথাটা অনেক উচুতে। আমি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি মাথা নেই। মাথাবিহীন একজন। পকেটথেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দেখি একটি সিগারেট আছে। কিন্তু ম্যাচে  একটি দিয়াশলাই কাঠি নেই। আমি শরীরের সমস্ত শক্তিতে দিলাম দৌড়। যতক্ষণ দম ছিল দৌড়াতে থাকলাম।  দৌড়াতে দৌড়াতে যেখানে থামলাম বামে তাকিয়ে দেখি কবরস্থান। কিছু কিছু পুরাতন কবরের ভিতরে গর্ত দেখা যাচ্ছে। ক’টি নতুন কবরের উপরে প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো।  সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। আবার ভয় পেয়ে গেলাম। দিলাম দৌড়। হাঁপিয়ে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। সামনে গিয়ে একটি ঘর দেখতে পেলাম। ঘরের ভিতরে আলো জ্বলছে। আমি কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাই। কাছে গিয়ে ঘরের দরজা  খোলা দেখে কোনো রকম দিধা না করে ভিতরে ঢুকে যাই। তিনজন ছেলে মানুষ ভিতরে শুয়ে আছে। আমি তাদের ডাকলাম, ভাই…..ও ভাই…উঠেন। আমার ডাকে তাদের সাড়া নেই। মুখ থেকে মদের ঘন্ধ আসছে। সবাই মদ খেয়ে টাল হয়ে ঘুমিয়েছে। এরা মনে হয় এখানকার পাহারাদার। আমি তাদের ডেকে তুলতে ব্যর্থ হই। মেঝেতে পড়ে ছিল তাদের সিগারেটের প্যাকেট আর ম্যাচ। আমি এগুলো আমার পকেটে নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকি। প্রায় দশ থেকে পনের কিলোমিটার পথ হেটে এসেছি। কালীবাজার চলে এসেছি। বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ। আর একটু সামনেই হামিদ চাচার বাড়ি। তার বাড়িতে গিয়ে  গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে হামিদ চাচা, হামিদ চাচা বলে জোরে  জোরে চিতকার করতে থাকলাম। তখন ফজরের আজান শুনতে পেলাম। হামিদ চাচা বের হয়ে এসে আমাকে বললেন, আরে রাজীব তুমি এই সময়ে কই থেকে আসলা? কিভাবে আসলা? আমি বললাম, বলছি আগে আমাকে পানি পান করতে দিন। আমি খুব তৃষ্ণার্থ। বাড়ির সবাই ইতিমধ্যে  জেগে উঠেছে। আমাকে ঘিরে সবার কৌতুহল।
বনানী, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment