Thursday, November 22, 2012

মালয়েশিয়া বেড়ানো


  • রফিকুল ইসলাম সাগর 


মালয়েশিয়ার ভ্রমন ভিসা পেতে সময় লাগে তিন কার্য দিবস। মালয়েশিয়া পাহাড়ি দেশ। প্রাকীতিক সৌন্দর্যের দেশ। এক ঋতুর দেশ। প্রতিদিন বৃষ্টি হয়। বাইরের আবহাওয়া গরম। সম্পূর্ণ দেশ জুড়ে দেখা যায় পাহাড় আর জঙ্গল। যারা মালয়েশিয়া ঘুরতে আসেননি কিন্তু আসতে চান তাদের জন্য আমার নিজ ভ্রমন অভিজ্ঞতা থেকে একটি ভ্রমন প্ল্যান লিখলাম। 

টুইন টাওয়ার
কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর (কে এল আই এ) নামকরণ কুয়ালালামপুর হলেও বিমান বন্দরটি কুয়ালালামপুর মূল শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। তার পাশেই আরেকটি এয়ার এশিয়ার নিজস্ব বিমান বন্দর। এয়ার এশিয়াতে মালয়েশিয়া আসলে খরচ অনেক কম।  
কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে অবতরন করার পর মূল শহরে আসতে হলে আপনাকে টেক্সী অথবা বাস যোগে আসতে হবে। কুয়ালালামপুরে অবস্থান করার জন্য আপনি থাকার হোটেল বুকিট বিনতাং এলাকা বেছে নিতে পারেন। পর্যটক হিসেবে মালয়েশিয়া এসে বুকিট বিনতাং এলাকায় থাকলে আপনি সব রকমের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। বেশির ভাগ পর্যটক মালয়েশিয়া আসার পর থাকার জন্য বুকিট বিনতাং এলাকার হোটেল গুলোই বেছে নেয়। হোটেলের ভাড়া দিন প্রতি ৫০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত থেকে ৫০০ রিঙ্গিত পর্যন্ত। আপনার রুচির উপর নির্ভর করবে আপনি কোন হোটেলে থাকবেন।  

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে বুকিট বিনতাং আসতে হলে টেক্সী যোগে ভাড়া লাগবে ৭০-১০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। বাসে আসতে চাইলে ১০ রিঙ্গিত। বাস আসবে পুডু পর্যন্ত। পুডু থেকে নেমে একটু হেটে সামনের দিকে আসলেই বুকিট বিনতাং। এখান থেকে আপনি বাসে অথবা টেক্সিতে করে যেখানে খুশি যেতে পারবেন। বুকিত বিনতাংয়ে মালয়েশিয়ার অতি পরিচিত শপিং মার্কেট পেভিলিওন। তবে পেভিলিওন মার্কেট থেকে কেনাকাটা না করাই ভাল। সেখানে সব কিছুর মুল্য অনেক বেশি। রাতে বুকিত বিনতাংয়ের সড়ক গুলোতে গানের আসর হয়। নানা রকমের খাবার দোকান বসে। 

বাতু গুহা

বাতু গুহা- হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য কুয়ালালামপুরের সব চেয়ে আকর্ষনীয় এবং সুন্দর জায়গা বাতু গুহা। পাথরের গুহার ভিতরে মন্দির। প্রায় ১০ তলা সমান উচু সিড়ি বেয়ে গুহায় প্রবেশ করতে হয়। মূল গেইটের একটু ভিতরেই বিশাল বড় মূর্তি। আসে পাশের পাহাড় এই গুহার সৌন্দর্য আরো ফুটিয়ে তুলেছে। এছাড়া দেখতে পাওয়া যায় শত শত কবুতর ও বানর। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক বিভিন্ন দেশ থেকে বাতু গুহায় ভীর করেন। 

টুইন টাওয়ার- মালয়েশিয়া আসার পর টুইন টাওয়ার না দেখলে যেন সবই বৃথা। পুরো বিশ্বে পরিচিত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। মালয়েশিয়ার নাম আসলে সর্ব প্রথম টুইন টাওয়ারের নাম বলতে হবে। সন্ধার পর টুইন টাওয়ারের সামনে কে এল সি সি এলাকায় যাওয়াটাই সব চেয়ে ভাল সময়। সন্ধা থেকে পর্যটকদের আগমন বাড়তে থাকে। এই এলাকায় বসে আনন্দ মেলা/মিলন মেলা। রাতের টুইন টাওয়ারের সৌন্দর্য দিনের টুইন টাওয়ারের চেয়ে পুরো ব্যতিক্রম। আনন্দের সাথে যোগ হয় আলোক সজ্জায় সজ্জিত কে এল সিসি এলাকা


শ্রী মাহা মারিয়াম্মান মন্দির
জু-নিগারা-মালয়েশিয়ার জাতীয় চিড়িয়াখানা। নানান রকমের পশু-পাখি। বাঘ আর সিংহ ছাড়া সব প্রাণী ছোয়া যায়। পশু-পাখিকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলা যায় আদর করা যায়। জু-নিগারা থেকে বেড় হয়ে আসে পাশের শপিং মার্কেট গুলো ঘুরে দেখতে পারেন। পছন্দ মত কেনাকাটা করতে পারেন

চায়না টাউন: চায়না টাউন মূলত মার্কেট। মালয়েশিয়ার সব চেয়ে কম মূল্যে পণ্য কেনা বেচার মার্কেট। সেখানে বেশির ভাগ বিদেশীদের কেনা কাটা করতে দেখা যায়। তবে চায়না টাউন থেকে আপনাকে দামদর করে পণ্য কিনতে হবে। 

শ্রী মাহা মারিয়াম্মান মন্দির: চায়না টাউনের সাথেই এই মন্দিরটির অবস্থান। ১৮৭৩ সালে 'থামবোসামি পিল্লাই' নামক একজন এই মন্দিরটি তার নিজ উদ্যেগে বানিয়েছিলেন। তখন এই মন্দিরটি ছিল তার ব্যক্তিগত পারিবারিক মন্দির। ১৯২০ সালে এই মন্দিরটি সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় 

কে এল টাওয়ার: কে এল টাওয়ারের উপর থেকে কুয়ালালামপুর শহর দেখার দৃশ্য দেখতে মিস করবেন না। বিশেষ করে রাতের বেলা। রাতের দৃশ্য আমার চোখে সব চেয়ে সুন্দর লাগে। কে এল টাওয়ার উঠতে জনপ্রতি খরচ হয় ৩০ রিঙ্গিত


কে এল টাওয়ার
পুত্রাজায়া: কুয়ালালামপুর থেকে যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। যেতে পারেন বাস যোগে অথবা টেক্সিতে। তবে বাসে যাওয়াটাই সব চেয়ে ভাল। খরচ কম। মালয়েশিয়া ফেডারেল সরকারের বর্তমান রাজধানী পুত্রাজায়া। এই শহরের নাম করণ করা হয়েছে মালয়েশিয়ার প্রথম প্রধান মন্ত্রী টুঙ্কু আব্দুর রহমান পুত্রার নামনুসারে। 
*পারদানা পুত্রা: এটি শহরের প্রধান পাহাড়ে অবস্থিত যা মালয়েশিয়ান সরকার প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়। 
*পুত্রা মসজিদ: শহরের প্রধান মসজিদ। 
*পুত্রাজায়া স্বাধীনতা স্কয়ার: বিভিন্ন উত্সব ও প্যারেড এখানে অনুষ্ঠিত হয়।  
পুত্রা সেতু: ৩৩৫ মিটার দীর্ঘ দর্শনীয় সেতুটি মনরেল (মেট্রো রেল),যানবাহন ও পথচারী চলাচলের জন্য তিনটি আলাদা আলাদা স্থরে বিভক্ত। 
* পুত্রাজায়া হৃদ: ৬৫০ মিটারের এই কৃত্তিম হৃদ নগরীকে ঠান্ডা রাখার জন্য নির্মিত। এটি এখন মালয়েশিয়ার জ্বলক্রীড়ার প্রধান স্পটে পরিনত হয়েছে। 


মালাক্কা: মালয়েশিয়ার প্রথম শহর মালাক্কা। ১৫১১ সালে পোর্তুগিজদের হাত ধরে মেলাক্কাতে ইউরোপীয় উপনিবেশের পত্তন ঘটলেও বহু আগে থেকেই চিনা, ভারতীয় ও আরব নাবিকদের আনাগোনায় মিশ্র সংস্কৃতির এই শহর গড়ে উঠেছিল। মেলাক্কাকে মালয়েশিয়ার ইতিহাসের শহর বলা যায়। সুমাত্রার রাজপুত্র পরমেশ্বর এই নগরীর পত্তন করেন। মালয়েশিয়ার বিচিত্র বর্ণময় ইতিহাসের একটা বড়ো অংশই রয়েছে মেলাক্কাকে ঘিরে। পুরোনো মেলাক্কায় সেন্ট পলের চার্চ ও দুর্গের ভগ্নাবশেষটিই ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন। যাঁরা গোয়ায় সেন্ট জেভিয়ার্সের সমাধি দেখেছেন তাঁরা ইতিহাস খুঁজতে এখানে আসতেই পারেন। ১৫৩৩ সালের ২২ মার্চ থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেন্ট জেভিয়ার্সের দেহটি এখানেই সমাধিস্থ ছিল।
মালাক্কা

পেনাং: মালয়েশিয়ার দীর্ঘতম সমুদ্র বন্দর পেনাং। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জাহাজের মালামাল খালাশ করা হয় এখানে। এশিয়ার দীর্ঘতম সেতু দেখা যাবে পেনাংয়ে। এশিয়ার দীর্ঘতম এবং বিশ্বে পঞ্চম ১৩.৫ কিলোমিটার পেনাং ব্রিজ 
ব্রিটিশ উপনিবেশের স্মৃতিচিহ্ন সেন্ট কর্নওয়ালিস ফোর্ট ও সেন্ট জর্জেস চার্চ। চার্চের গায়েই পেনাং মিউজিয়াম পেনাং-এর অতীত ইতিহাসের সাক্ষী। 
পেনাং থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে মালয়েশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমন্দির কেক লোক সি বর্মীয়, চিনা ও থাই স্থাপত্যের সংমিশ্রণের নির্দশন। সাততলা প্যাগোডা বা বান পো থর চমৎকৃত করে। ছোটো ট্রেনে চড়ে পাহাড়ের বুকে একের পর এক টানেল পেরিয়ে মিনিট কুড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায় ২,৪২৮ ফুট উচ্চতায় পেনাং পাহাড়ের মাথায়। উপর থেকে অসাধারণ লাগে বিস্তীর্ণ দ্বীপভূমি। এখান থেকে আরও ৬ কিলোমিটার দূরে বোটানিক্যাল গার্ডেন। জর্জটাউন থেকে বাসে আয়ার ইতামে পেনাং হিল কেবল ট্রেন স্টেশনে পৌঁছোতে হবে। শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে রঙবেরঙের প্রজাপতির দুনিয়া বাটারফ্লাই ফার্ম। ১২ কিলোমিটার দূরে সর্পমন্দির। 
পেনাং থাকার জন্য আছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল। সমুদ্র পাড়ে কাটাতে পারেন সুন্দর কিছু মুহুর্ত। সাথে জ্বলে গা ভিজাতে ঝাপ দিতে পারেন সমুদ্রের বুকে। প্রাকিতিক সৌন্দর্যের সাথে আশা করি ভালই সময় কাটবে। 
লংকাউই


লংকাউই: পেনাং থেকে ১১২ কিলোমিটার দুরে লংকাউই। যাওয়া যায় আকাশ/জ্বল পথে। পেনাং থেকে জ্বল পথে জাহাজে করে লংকাউই যাওয়াটা খুব উপভোগ্য। যেতে সময় লাগবে প্রায় ৫ ঘন্টা। যাওয়ার পথে চোখে পড়বে অনেক গুলো ছোট ছোট দ্বীপ। 
আমার চোখে মালয়েশিয়ার সব চেয়ে সুন্দর জায়গা লংকাউই। সমুদ্রে ঘেরা চারদিক লংকাউই দ্বীপ সিঙ্গাপুরের চেয়েও নাকি বড়। লংকাউই পৌছে যাতায়াতের জন্য গাড়ি অথবা মটর সাইকেল ভাড়া নিতে পারেন। প্রাইভেট কার ভাড়া নিতে গেলে খরচ হবে দিন প্রতি ৬০ রিঙ্গিত। মটর সাইকেল দিন প্রতি ৩০ রিঙ্গিত। প্রাইভেট কার,মটর সাইকেল যাই ভাড়া নিন না কেন চালাতে হবে আপনাকে নিজে। আর হ্যা অবশ্যই ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে (যে কোন দেশের)। ক্যাবল কার লংকাউইর সব চেয়ে বড় আকর্ষণ। ক্যাবল কারে উঠতে খরচ হয় জনপ্রতি ৩০ রিঙ্গিত। লংকাউইতে আবাসিক হোটেলে থাকতে হলে ভাড়া লাগবে ৬০ থেকে ১০০ রিঙ্গিত দিন প্রতি। 


মালয়েশিয়ায় খাবার: বিশ্বের অনান্য দেশের চেয়ে মালয়েশিয়ার খাবার খরচ অনেক কম। দিনপ্রতি তিন বার খাবার খেতে আপনার খরচ হবে ১৫ থেকে ২৫ রিঙ্গিত। খাবারের তালিকায় থাকবে মাছ,মাংশ,শাক-সবজি সহ অনান্য খাবার আপনার পছন্দ মত বেছে নিতে পারেন। পানির দাম মালয়েশিয়ায় বেশি পানি কিনে নিতে হবে ১.৫ লিটার পানির দাম ২ রিঙ্গিত কোথাও কোথাও আরো বেশি। মালয়েশিয়ানরা খাবারে একবারেই ঝাল কম খায়। এখানকার সব চেয়ে জনপ্রিয় খাবার নাসি গরেং। ভাত কে বলা হয় নাসি। ভাতের সাথে ডিম মাংশ মিক্স করে খাবার তৈরী করা খাবারকে বলে নাসি গরেং। গরুর মাংশ খেতে চাইলে নাসি গরেং দাগিং,মুরগির মাংশ নাসি গরেং আয়াম,চিংড়ি মাছ হলে নাসি গরেং উদাং। ফাস্ট ফুড খাবার খেতে চাইলে আছে Mcdonalds,KFC.


ছবি : লেখক 

No comments:

Post a Comment