Wednesday, April 22, 2015

ছড়ায় গানে হাতিরঝিলে

ঢাকায় পর্যটকদের কাছে এখন আকর্ষণীয় স্থান হাতিরঝিল। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে থাকে উৎসব মুখর পরিবেশ। ঢাকার তরুণ-তরুণীরাও অবসর সময়ে আড্ডা দিতে চলে আসেন হাতিরঝিলে। এমনি এক আড্ডার কথা লিখেছেন_ রফিকুল ইসলাম সাগর

'হাতিরঝিলে আনলিমিটেড আড্ডা জমাবো' ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দেয়ার পর অনেকে মোবাইলে ফোন করে, কেউ কেউ কমেন্টস করে আড্ডায় যোগ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষ করে মহাখালী থেকে কবির খন্দকারকে সঙ্গে নিয়ে ছুটি হাতিরঝিলের পথে। চলতি পথে ছড়াকার জগলুল হায়দার ভাই ফোন করে জানালেন তিনি মিরপুর থেকে হাতিরঝিল আসছেন। হাতিরঝিল পৌঁছে দেখা হয় সাইমুন সাদ, আনাস বিল্লাহ ও সমুদ্র বিপ্লবের সঙ্গে। কথা ছিল যে সবার শেষে হাতিরঝিল আসবে তাকে জরিমানা বাবদ সবাইকে ঝালমুড়ি খাওয়াতে হবে। এই কারণেই তারা তিনজন সবার আগে এসে হাজির। জানতে পেরেছিলাম সবার আগে এসেছিল আনাস বিল্লাহ। প্রচ- রোদে আমরা একটি বিল বোর্ডের পিছনে ছায়ায় আশ্রয় নেই। এরই মধ্যে হাজির হলেন ছড়ার নায়ক জগলুল হায়দার ভাই। তিনি আমাদের সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোলাকুলি শেষ করতে না করতেই তার সঙ্গে কে আগে ছবি তুলবে এ নিয়ে ঝগড়া বেধে গেল কবির খন্দকার, সমুদ্র বিপ্লব ও সাইমুন সাদের মধ্যে। কেউ কাউকে আগে ছবি তুলতে দিবে না, পরে গ্রুপ ছবি তুলে ঝগড়ার সমাপ্তি ঘটল। চা পান করে কোথায় বসা যায় জায়গা খোঁজা শুরু হলো। জায়গা তো আছে অফুরন্ত কিন্তু প্রচ- রোদ তাই ছায়ায় বসতে হবে। অনেক গরমে একটু একটু শান্তির বাতাস উড়ে এসে গায়ে লাগছিল আহ! কি যে শান্তি।

সত্যি কথা বলতে হাতিরঝিলের মতো স্থাপনার তুলনা হয় না। অনেকে বর্তমান হাতিরঝিলকে বিদেশের কোনো শহরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আগে এখানে শুধুই ঝিল ছিল, যে ঝিলে হাতি গোসল করানো হতো। এখন হাতি নেই, ঝিল আছে। ঝিলের ওপর মাটি ভরাট করে হয়েছে রাস্তা। হাতিরঝিলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কর্তিপক্ষ এখনও নানা রকমের কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছসহ এবার গিয়ে লক্ষ্য করলাম বেশ কিছু জায়গাজুড়ে দাবা খেলার জন্য বিশেষ আয়োজন। দামি লাল ইট-পাথর দ্বারা নির্মিত দাবা খেলার ঘর এবং দুই পাশে দুজনের বসার ব্যবস্থা। এছাড়া সড়ক বেশ পরিষ্কার মনে হয়েছে। আশা করছি এই সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার পরিছন্নতার ব্যাপারে কর্তিপক্ষের কার্যকর ভূমিকা থাকবে আজীবন।

হাতিরঝিলের ব্রিজে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক দৃষ্টি আমাদের সবার। তখনও আরাম করে বসার জায়গা খুঁজে পাইনি। জগলুল হায়দার ভাই রাস্তার পাশে একটি জায়গা দেখিয়ে বললেন, 'ওইযে ওদিকে গিয়ে ঘাসের ওপর বসি। ওখানে একটু ছায়া আছে।' বললাম ঠিক আছে ভাই চলেন। মাটিতে অনেক বড় বড় সবুজ ঘাসে সবাই বসলাম। শুরু হলো মূল আড্ডা। আনাসকে জগলুল ভাইয়ের উপদেশ- ফেসবুকের চেয়ে পড়াশুনায় বেশি সময় দাও। তারপর একে একে এসে হাজির হলো রিদওয়ানুর রহমান, সৈয়দ সিমান্ত, বিষাদ ও রাসেল। সবার অনুরোধ ছড়ার নায়কের লেখালেখির শুরুর কথা শুনব। জগলুল হায়দার ভাই জানালেন, একদিন তার মনে হলো তার বাবাকে অবাক করার জন্য কিছু একটা করবেন এবং একটি ছড়া লিখলেন। তার প্রথম ছড়াটি ছিল এরকম 'মশা তরে দিমু ঘষা।' তার লেখা প্রথম ছড়া প্রকাশ হয়েছিল একটি স্কুলের বার্ষিকীতে তার ছোট বোনের নামে। ছোট বোন তাকে না জানিয়ে তার ডায়েরিতে লেখা ছড়াটি বার্ষিকীতে দিয়েছিল। সেই থেকে শুরু এখন পর্যন্ত তিনি অদ্বিতীয়। একে একে আমরা তরুণ লেখকরা বাদাম আর আলুর চিপস খেতে খেতে আমাদের লেখালেখির অনেক কথা সবার সঙ্গে শেয়ার করি। জানলাম অনেক অজানা কথা। আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন জেলার মানুষ। কেউ ঢাকার, কেউ ভৈরবের, কেউ কিশোরগঞ্জের, কেউ ময়মনসিংহের, কেউ চট্টগ্রামের, কেউ গাজীপুরের, কেউ নওগার ছেলে। কারও সঙ্গে কারও আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। শুধু মনের সঙ্গে মনের মিল সেই টানে সবার ছুটে আসা। আড্ডায় প্রস্তাব করা হয় এরকম আড্ডা প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার হোক। প্রস্তাবে উপস্থিত সবাই সম্মতি প্রকাশ করে। সবার অনুরোধে জগলুল হায়দার ভাই তার আলোচিত এবং ব্যাপক জনপ্রিয় 'ছাগল শুমারি' ছড়াসহ ডজন খানেক ছড়া আবৃত্তি করে সবাইকে মুগ্ধ করলেন। কিছু কিছু ছড়া শুনে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা অবস্থা হয়েছিল। তার ছড়া আবৃত্তির পর থেকে সবাই কেমন যেন ছড়ায় ছড়ায় কথা বলতে শুরু করল। এবার তিনি গান ধরলেন। তার লেখা অসাধারণ কয়েকটি রক্ত গরম করা গান গেয়ে আমাদের মাতিয়ে তুললেন। তার সঙ্গে সুর মিলাতে থাকি আমরা। গান শুনে কয়েকজন এসে বলল আপনাদের সঙ্গে বসতে পারি? আমরা আপত্তি করলাম না। তারাও আমাদের সঙ্গে সুর মিলাল। গান চলতেই থাকল। বাদ্যযন্ত্র নেই তাতে কী গানের সঙ্গে সঙ্গে সবাই হাততালি দিয়ে দিয়ে বাদ্যযন্ত্রের কাজ চালিয়ে নিচ্ছিলাম।

সূর্যটা আড়াল হয়েছে। তখনও অন্ধকার হয়নি। আশপাশে তাকিয়ে দেখি হাতিরঝিলের পথে পথে মানুষ আর মানুষের মিলন মেলা। দলে দলে মানুষ এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে যার মতো আনন্দ করছে। সন্ধা ৬টায় জগলুল হায়দার ভাই বললেন এবার তাকে যেতে হবে। তিনি আমাদের রেখে আড্ডা থেকে বিদায় নিলেন। বাকিরা সবাই অবস্থান করলাম। আড্ডা হয়ে পড়ল অভিভাবকহীন। ক্ষণিকের জন্য সবাই কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। নিজের মনের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে গেলাম কিছুক্ষণ। তারপর আবার আড্ডা। কেউ কেউ একে অপরের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ করতে থাকে। সবার শেষে আড্ডায় যোগ দিতে আসে নাদিম মজিদ। সে অবশ্য আগেই জানিয়েছিল আসতে লেট হবে। লেটে এসে ক্ষতিটা তারই হয়েছিল। মিস করলো অনেক কিছু। ঘড়ির কাটায় সন্ধা ৭টা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি। নীড়ে ফিরতে হবে। আমি আর কবির খন্দকার আড্ডা থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের পিছু পিছু আনাস বিল্লাহ ও রিদওয়ানুর রহমান উঠে এলো আড্ডা থেকে। রাতের বেলা বিভিন্ন রঙয়ের বাতির আলোক সজ্জা হাতিরঝিলের সৌন্দর্য চরম আকর্ষণীয় করে তুলে। যা এক কথায় বলব অসাধারণ। ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল কি যেন করি নাই। নীড়ে ফিরে মনে হলো ও আচ্ছা! ঝালমুড়ি খাই নাই।

হাতিরঝিলের সব কিছুই ঠিক আছে তবে, পর্যটকদের নিরাপত্তা, অসামাজিক কার্যকলাপ, মাদক সেবন বন্ধে কর্তিপক্ষের বিশেষ নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি। সুস্থ পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। হাতিরঝিল আমাদের সবার এর সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। 


- See more at: http://sangbad.com.bd/old/index.php?ref=MjBfMDlfMDZfMTNfM18yN18xXzE0MTQ0Nw%3D%3D#sthash.ubqvfgog.dpuf

দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত (শুক্রবার, ২২ ভাদ্র ১৪২০, ২৯ শাওয়াল ১৪৩৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩)

No comments:

Post a Comment