Wednesday, April 22, 2015

আখাউড়া জংশনে একবেলা

রফিকুল ইসলাম সাগর

আমি প্রকৃতিকে ভালবাসি। প্রকৃতির কাছে যাওয়ার জন্য কখনো কখনো মাতাল হয়ে যায় আমার মন। তাই তো সুযোগ  পেলেই ছুটে যাই প্রকৃতির সান্নিধ্যে। বারবার যাই, শান্ত করি প্রকৃতি প্রিয় আমার মাতাল মনকে। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা ভ্রমনে জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। জানা যায় সেই জায়গা সম্পর্কে, সেখানকার মানুষ সম্পর্কে, তাদের কথাবার্তা, আচার ব্যবহার সম্পর্কে এবং তাদের জীবন যাপন সম্পর্কে। একেকটা অঞ্চলের মানুষ একেকভাবে অতিথি আপ্যায়ন করে। মানুষের সাথে মিশতে, মানুষ সম্পর্কে জানতে আমার কৌতুহল সব সময়। আমি জানতে চাই, সবাইকে জানাতে চাই এই উদ্যেশ্য নিয়েই এখান  থেকে ওখানে ছুটে বেড়াই। অনেকদিন থেকে ঢাকা ছেড়ে দূরে  কোথাও যাওয়ার জন্য অস্থির ছিল মন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হচ্ছিল না। বন্ধু ইমন, আমি ও আশিক সকালে বিমান বন্দর রেল স্টেশনের পথে যাত্রা করি। ঠিক করলাম ট্রেনে করে আখাউড়া জংশনে যাবো। এক  ট্রেনে যাব আরেক ট্রেনে ফিরব। মহাখালী থেকে বিমান বন্দর রেল স্টেশন যাই।  বেলা ১২:৩২ মিনিটে বিমান বন্দর রেল স্টেশনের প্লাট ফর্মে জয়ন্তিকা ট্রেনটি থাকার নির্ধারিত সময়। জয়ন্তিকা সিলেটগামী আন্তনগর ট্রেন। কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় বেলা ১২টা। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর জয়ন্তিকা ট্রেনটি  স্টেশনে আসলো। অনেক মানুষের ভীর ঠেলে ট্রেনের একটি বগিতে উঠার সুযোগ হল আমাদের। 
আমাদের স্ট্যান্ডিং টিকেট দাড়িয়ে যেতে হবে। ভাগ্যক্রমে যদি কোনো সিট খালি পাই এই আসায় এক বগি থেকে অন্য বগি খুঁজে কোনো সিট খালি পেলাম না।  ট্রেন ছুটে চলছে তবে অনান্য দিনের চেয়ে ধীর গতিতে। ট্রেন যখন কোনো স্টেশনে থামে আশিকের প্রশ্ন, এইটা কোন জায়গা? আমি বারবার উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গেলাম প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে। কখনো  ট্রেন চলন্ত অবস্থায় প্রশ্ন করে, এইটা কোন জায়গা? ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দু’পাশের লোহার হাতল শক্তহাতে ধরে চলন্ত ট্রেন থেকে পারিপার্শিক দৃশ্য আমি দারুন ভাবে উপভোগ করছিলাম। তারসাথে দুরন্তগতিতে ছুটে আসা বাতাস আমার শরীর স্পর্শ করে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল আবেগের রঙিন জগতে। মনে মনে কতো যে ভাবনা আর কথা বলছিলাম। কোনো স্টেশনে ট্রেন থামলেই যেন ধ্যান ভেঙ্গে রঙিন জগৎ থেকে ফিরে আসতে হয়। পাশাপাশি প্লাটফর্মে নেমে সিগনাল বাতির দিকে তাকিয়ে গ্রীন সিগনালের জন্য অপেক্ষা। এভাবে করে কেটে যায় কয়েক ঘন্টা। যেসব স্টেশনে যাত্রা বিরতি না দেয়ার কথা সেই  স্টেশনেও যাত্রা বিরতি করে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘন্টা দেরিতে আমরা আজমপুর রেল স্টেশনে পৌঁছি। জয়ন্তিকা  ট্রেনটি আখাউড়া থামে না তাই আখাউড়ার যাত্রীদের আজমপুর স্টেশনে নামতে হয়। আজমপুর থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় দশ টাকা ভাড়া আখাউড়া যেতে। আজমপুর নেমে আমরা রেল লাইন দিয়ে হাটা শুরু করি। হেটেই আখাউড়া  স্টেশন যাবো বলে ঠিক করলাম। রেল লাইনের দুই পাশে পিয়ারা বাগান। চমৎকার সবুজ দৃশ্য। মানুষের আনাগোনা খুব একটা দেখলাম না। আশিক আমাদের কিছু না বলে ঢুকে পড়ল একটি পেয়ারা বাগানের ভিতর। যখন দেখলাম বুকের ভিতরে ধুক ধুক করছিল এই ভয়ে যে, বাগানের মালিক দেখলে না জানি কী হয়। আশিককে ধমকের সুরে ফিরে আসতে বললাম। সেও নাছর বান্দা গাছ থেকে কিছু পিয়ারা ছিড়ে নিয়ে তবেই ফিরল। ভাগ্য ভালো ছিল কেউ দেখেনি। পেয়ারা কামড়ে চিবুতে চিবুতে হেটে চলছিলাম রেল লাইন দিয়ে। আখাউড়া জংশনে পৌঁছে জেনে নিলাম ফিরতি ট্রেনের সময় সূচী। সন্ধ্যা ৭টায় ট্রেন। আমাদের হাতে সময় তিন ঘন্টা। অনেক পরিচিত এই জংশন, ছোট বেলা থেকে এখানে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি। আমি আগেও অনেকবার এসেছি। আখাউড়া জংশন থেকে কাছাকাছি আমার ফুফুর বাড়ি। আখাউড়া বাংলাদেশের বিহত্তর একটি জংশন, দিন রাত ২৪ ঘন্টা খুবই ব্যস্ত থাকে। 
দেখতে  পেলাম একটি লোকাল ট্রেন প্লাটফর্মে এসে থেমেছে। যাত্রীরা ধাক্কা ধাক্কি করে ট্রেনে উঠছে। বগি গুলোর ভিতরে লাইট জ্বলছে না অন্ধকার! ভিতরে মানুষের হইচই। কিছুক্ষণ পর কয়েকবার হর্ন বাজলো তারপর লোকাল ট্রেনটি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেল। ট্রেনটি প্লাটফর্ম অতিক্রম করারপর আমরা রেললাইনের এপাশ থেকে ওপাশে গেলাম। একটি চায়ের দোকানে গিয়ে প্রথমে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। পরে চা-পান করে এদিক-সেদিক হেটে নানান রকমের মানুষ আর কারো কারো কাজকর্ম দেখছিলাম। আমাদের সাথে আরো অসংখ্য মানুষের ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষা। জংশনে লক্ষ্য করি একজন পুলিশ দু’জন ছেলের পিছন পিছন যাচ্ছে আর বলছে, আমার ভাগ কই। কিসের ভাগ তা জানতে পারিনি। এরই মধ্যে মাইকে ঘোষণা শুনতে পাই মহানগর গৌধুলি ট্রেনটি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে এক নম্বার প্লাটফর্মে এসে দাড়াবে। ততক্ষণে বেলা শেষে সন্ধ্যা আমরা ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সন্ধ্যা ৭টার একটু আগে চট্টগ্রাম  থেকে ছেড়ে আসা গৌধুলি থামল। দ্রুত গতিতে ছুটেচলা ট্রেনের জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে যাওয়া ক্ষনিকের বাতির আলো আঁধার গ্রামের পথে ছড়াতে ছড়াতে ঢাকায় ফিরলাম।

No comments:

Post a Comment