-রফিকুল ইসলাম সাগর
নেপাল পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় একটি দেশ। প্রাকীতিক সৌন্দর্যের দেশ। নেপালের এভারেস্ট পুরো বিশ্বে পরিচিত। মালয়েশিয়া বিদেশী শ্রমিকদের মধ্যে নেপালী শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক। মালয়েশিয়া সরকার নেপালীদের মালয়েশিয়াতে কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। নেপালীদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি দালাল মারফত নেপালীদের মালয়েশিয়া যেতে খরচ হয় এক লক্ষ্য দশ হাজার টাকার মতো। কেউ যদি নিজে নিজে সব ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে খরচ অনেক কম। মালয়েশিয়াতে বেশিরভাগ নেপালী নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কাজ করছে। নেপালীরা এখানে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি, আর্থিক অবস্থা আমাদের দেশের চেয়েও অনেক খারাপ এই কথা হয়তো অনেক বাংলাদেশীই জানেন না।
মালয়েশিয়াতে একটি ৫ তারা হোটেলে তিন মাস কাজ করেছি। সেই হোটেলটিতে অনেক নেপালী কর্মী ছিল। প্রতিদিন কাজের ফাকে ফাকে অনেক নেপালির সাথে কথা হয়েছে। জানার কৌতুহল থেকে নেপালীদের কাছে তাদের দেশ সম্পর্কে, তাদের সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি। তাদের কাছে জেনেছি বেশিরভাগ নেপালী পুরুষরা বিশ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে করে। প্রায় সবাই প্রেম করে বিয়ে করে। প্রথমে প্রেম তারপর পারিবারিক ভাবে বিয়ে। বিয়ের পরপরই বেশিরভাগ পুরুষ বিদেশে চলে যায়। এছাড়া বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এমন মেয়ের সংখ্যাও অনেক। নেপালী যাদের সাথে আমার কথা হয়েছে তার মধ্যে হাতে গোনা গোনা ক'জন বাদে সবাই ছিল বিবাহিত। বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। এছাড়া মালয়েশিয়াতেও অসংখ্য নেপালী মেয়েদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে দেখা যায়। বলা যায় নেপালীরা প্রবাস মুখী। তাদের অনেকের স্বপ্ন দুবাই যাওয়া। অনেক চেষ্টা করে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়ে যখন উত্তীর্ণ হয় না তখন তারা বেছে নেয় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও চীন এই সব দেশ। অনেকে আবার দুবাই যাওয়ার খরচ বেশি বলে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও চীনের মত দেশ বেছে নেয়। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড যেতে খরচ কম। কোনো ইন্টারভিউ দিতে হয় না চাকরির জন্য। ভবিষ্যত নিয়ে তাদের স্বপ্ন কি জানতে চাইলে বেশিরভাগ নেপালিদের কাছে একই কথা শুনেছি, এখান থেকে টাকা উপার্জন করে ২-৩ বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ করে তারা পরবর্তিতে দেশে ফিরে গিয়ে দুবাই যাবে। কেউ কেউ বলেছেন নিজের দেশে ফিরে গিয়ে ব্যবসা করার কথা।
যাদের সাথে কথা বলেছি জেনেছি টাকা আয় করে জমানো, ভাল ভাবে ইংলিশে কথা বলা, বিদেশ সম্পর্কে বাস্তব ধারণা ও কাজের দক্ষতা অর্জনের জন্য তারা মূলত মালয়েশিয়া এসেছেন। কথা বলে বুঝা গেল নেপালীরামালয়েশিয়ায় সন্তুষ্ট না। বেশি টাকা জমিয়ে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখেন। তারা মালয়েশিয়াতে ১২ ঘন্টা পরিশ্রম করে ৮০০-৯০০ রিঙ্গিত বেতন পায়। বছর বছর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর দায়িত্ব কোম্পানির। প্রতি মাসে বেতন পেয়ে ৬০০-৭০০ রিঙ্গিত পাঠিয়ে দেয় নেপালে। তারা খরচের জন্য রাখে ১০০-২০০ রিঙ্গিত। থাকা খাওয়ার খরচ বহন করে কোম্পানি।
নেপালের মুদ্রাকে বলা হয় নেপালী রুপি। বেশিরভাগ মানুষ হিন্দু ধর্ম অবলম্বী। নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ড অনেক উন্নত হলেও গ্রাম গুলো উন্নত না। প্রায় সব নেপালী হিন্দী ভাষায় কথা বলতে পারে। নেপালী ভাষা ও হিন্দী ভাষার সাথে কিছু মিল আছে। মালয়েশিয়ার এক রিঙ্গিত বাংলা টাকায় ২৩.৪০ টাকা এবং নেপালী ৩১.২২ রুপি (এই লেখাটি লেখা পর্যন্ত)। বাংলাদেশের ১ টাকা সমান নেপালী ১.৩৩ রুপি। নেপালিদের প্রিয় খেলা কেরাম বোর্ড। তাদের পুরো দেশ জুড়ে নাকি অনেক কেরাম বোর্ডের দোকান আছে। এই দোকান গুলোতে সারাদিন চলে কেরাম খেলা। কেরাম বোর্ড খেলা নিয়ে জুয়াও চলে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক, জুতা ও মাছ সহ আরও অনেক কিছু নেপালে যায়। পোশাক ও মাছ নাকি নেপালের চেয়ে বাংলাদেশে অনেক কম মুল্য। তাদের চেয়ে আমাদের পোশাক অনেক উন্নত। নেপালে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর সংখ্যাও অনেক।
নেপালীদের দাবী তাদের বর্তমান প্রধান মন্ত্রী ভাল না। তাদের কথায় বুঝা যায় তারা তাদের পূর্বের রাজাকে নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। অনেকে বলেন তাদের বর্তমান প্রধান মন্ত্রী ভাল না বলেই তাদের দেশের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। অনেকে জানালেন আমাদের পূর্বের রাজা অনেক ভালো ছিল।
আমার বড় ভাইয়ের বিয়ের ভিডিও চিত্র দেখিয়েছিলাম এক নেপালিকে। ভিডিও দেখে সে বলছে ঠিক এই ভাবে তো আমাদেরও বিয়ে হয়। তার কথায় বুঝলাম আমাদের দেশের বিয়ে এবং তাদের দেশের বিয়ে প্রায় একই ভাবে হয়। কিছুটা পার্থক্য রয়েছে মাত্র। এক নেপালী আমাকে প্রশ্ন করল তোমাদের দেশের একটি টিভি চ্যানেলের নাম বিটিভি তাইনা? আমি বললাম হ্যা ! কেন কী হয়েছে বিটিভির? সে বললো আমাদের দেশেও বিটিভি দেখা যায়, তবে সব সময় না, মাঝে মাঝে সিগনাল পায়, কখনো কখনো স্পষ্ট দেখা যায়, কখনো যায় না। কিছুটা অবাক হয়েছিলাম বিটিভি নেপালেও দেখা যায়। আবার খুশিও হয়েছিলাম আমাদের বিটিভি এতদূর পর্যন্ত দেখা যায় বলে। নেপালের টিভি চ্যানেলের সংখ্যা খুব বেশি না। কাঠমুন্ডতে ডিশ লাইনের প্যাকেজ ২০০ রুপি (২০-৩০ টি চ্যানেল)। কাঠমুন্ড ছাড়া গ্রামের মানুষ খুব একটা ডিশ দেখে না। গ্রামের মানুষ জাতীয় ২টি টিভি চ্যানেল নিয়েই সন্তুষ্ট। তাছাড়া ডিশ ছাড়া তারা ভারতের ক'টি চ্যানেলও দেখতে পায়।
নেপালীরা খুব কৃপণ প্রকিতির মানুষ। হিসাব ছাড়া এক টাকাও খরচ করে না। একদিন এক নেপালীকে নির্দিষ্ট একটি জায়গার কথা বলে আমার সাথে যেতে বলেছিলাম। সে বললো আমি যাবো না। কেন যাবে না? আমার কাছে টাকা নেই, বাইরে ঘুরে টাকা খরচ করলে সারা মাস চলতে পারবো না। সব মিলিয়ে নেপালীরা বন্ধু হিসেবে, মানুষ হিসেবে খারাপ না।
বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩, দৈনিক বর্তমানের প্রবাস পাতায় প্রকাশিত

No comments:
Post a Comment