Wednesday, July 15, 2015

মোবাইলের কিছু স্মৃতি কিছু অভিজ্ঞতা


  • রফিকুল ইসলাম সাগর  

অনেক বছর আগের কথা। তখন আমাদের বংশের মধ্যে মোবাইল ছিল ছোট চাচার আর আমার বাবার। বাবা মোবাইল সম্পর্কে কিছুই বুঝতেন না, আমরাও কিছুই বুঝতাম না বললেই চলে। তবে এতটুকু ধারণা ছিল যে নাম্বার চেপে নির্দিষ্টি একটি বাটনে টিপ দিলে ফোন করা যায়। আমার বড় ভাই প্রথম বাবাকে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে মোবাইল থেকে ফোন করতে হয়।

আমিও একটু-আকটু শিখে নিয়েছিলাম তখন। কিন্তু বাবার মোবাইল ধরতে সাহস হতো না। ধরলে যদি আবার কোনো বাটনে টিপ লেগে কিছু হয়ে যায়। মাঝে মাঝে বাবা বাথরুমে গেলে তখন যদি বাবার মোবাইলে কেউ ফোন করতো তাহলে ফোন রিসিভ করতাম, মোবাইলটি ধরতে গেলে হাত কাপত। বাটনে টিপ দিয়ে ফোন রিসিভ করে যখন ওপর প্রান্তের মানুষটির সাথে কথা বলতাম নিজেকে খুব বড় বড় মনে হতো। বাইরে বের হলে বন্ধুদের বলে বেড়াতাম আজ আমি আমার আব্বার মোবাইল দিয়ে কথা বলেছি। আমি তো সেই মুহুর্তে বন্ধু মহলের নায়ক। বন্ধুদের দিকে তাহলে মনে হতো তাদের খুব মন খারাপ, তাদের খুব হিংসে হচ্ছে তাদের বাবার কেন মোবাইল নাই? তারা কেন কথা বলতে পারেনা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। 
একটা সময় বাবার মোবাইল হাতে নেয়ার সাহস পাই। বাবা ঘুমিয়ে থাকলে মোবাইল লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। কী যে ভাব আমার। আমার হাতে মোবাইল। মানুষ জন আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। আমি মাঝে মাঝে হুদাই মোবাইলের রিংটোন বাজাতাম আবার ক্যানসেল বাটনে টিপ দিয়ে মোবাইল কানে চেপে ধরে বলতাম হ্যালো....পরে আবার বলতাম রং নাম্বার। আর বন্ধুদের সামনে গিয়ে যেই একটা ভাব নিতাম 'আমার আব্বার মোবাইল' আমারে আর পায় কে। ষ্টুডিওতে মোবাইল হাতে নিয়ে অথবা কানে চেপে ধরে নানান ভাব-ভঙ্গিতে ছবি তুলতাম। তখন আসে পাশের একশ পরিবারে একটি মোবাইল থাকা স্বপ্নের মত ছিল। আসল মোবাইল হাতে নিয়ে ছবি তোলা তো বিশাল ব্যাপার। 

একটা পর্যায়ে প্রায় সময়ে নানান প্রয়োজনে দোকান থেকে দশ টাকা মিনিটে বাবাকে আমাদের ফোন করতে হতো। একদিন বাবা বাসাতেও আম্মার জন্য মোবাইল কেনার প্রয়োজন অনুভব করে। আম্মার হাতেও মোবাইল চলে এলো। আম্মা মোবাইল সম্পর্কে কিছুই বুঝেনা, শিখিয়ে দিলেও ভুলে যায়। সেই সুবাদে মোবাইল থাকতো আমার কাছে নয়তো ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া বাসায় থাকলে তার কাছে আর বাইরে থাকলে আমার কাছে। বাসায় কেউ বেড়াতে এলে হুদাই রিংটোন বাজাতাম এটাই ছিল সেই সময়ে মোবাইলের ফ্যাশন। আমাদের মোবাইল আছে দেখাতে হবে না। একটা সময়ে ভাইয়া মোবাইল পেলো। আব্বার সিটিসেল মোবাইলটিতে অন্য কোনো সিম বা রিম কার্ড ব্যবহার করা যেত না। গ্রামীন ফোন বাংলাদেশে এলো। আব্বা মোবাইল পরিবর্তন করে গ্রামীনের সিম কার্ড কিনে। আমি পেলাম ব্যবহার করার জন্য আব্বার পুরাতন সিটিসেল মোবাইল। এরপরেই সিটিসেল মোবাইল নিয়ে এলো যে মোবাইলে রিম কার্ড ব্যবহার করা যায়। 

টেলিটক নামে সরকারী মোবাইল ফোন বাজারে আসবে। সবার আকর্ষণ সেই সিম কার্ডের দিকে। এ যেন সোনার ডিম পারা মুরগী। টি এন্ড টি ল্যান্ড ফোনেও ফোন করা যাবে, ইনকামিং এর সুবিধাও আছে। মোবাইল আর ল্যান্ড ফোন সমান টাকায় কথা বলা যাবে। এছাড়া সব চেয়ে কম কল চার্জ। এই সিম কার্ড তো লাগবেই। কীভাবে পাওয়া যায়? অপেক্ষা।....
অনেকের সাথে টেলিটক সিম কিনতে টি এন্ড টি অফিসের সামনে লাইনে দাড়িয়েছিলাম। কিন্তু মানুষের পারা, চাপা খেয়ে, ঠেলাঠেলি করেও সিম পাইনি। কী আর করা....
খালাতো ভাইদের সাথে আগের দিন রাতে কাথা-বালিশ নিয়ে চলে গেলাম টি এন্ড টি অফিসের সামনে। গিয়ে দেখি এ কী কান্ড আমাদের আগেই শত শত মানুষ কাথা-বালিশ নিয়ে সেখানে সিরিয়াল দিয়ে বসে আছে। এবারও টেলিটক সিম পেলাম না। ঠিক করলাম দূর এত কষ্ট ! সিমই কিনুম না। 

ঘোষণা দেয়া হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে আবেদন করলে লটারির মাধ্যমে টেলিটক সিম বিক্রি হবে। পরিবারের সবার নামে আবেদন করলাম। লটারিতে বাবার নাম এলো। আর দেরী না করে ২,৯০০শ' টাকায় সিম কিনে আনলাম। ইয়াহু..... আমি আলাদিনের চেরাগ পাইছি।

এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল। মোবাইল ফোন এবং সিম কার্ড কোম্পানিদের এমন ভাব 'এত কম দামে মোবাইল দিতাছি তার পরেও কিনবেন না কেন'? সবাই মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার বুঝতে শিখেছে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সারাদিন টিভিতে, পত্রিকায় এত এত মোবাইল ফোন ও সিম কার্ডের বিজ্ঞাপন মোবাইল না কিনে উপায় আছে। মোবাইল ছাড়া আমরা বলতে গেলে এখন অচল। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক সহজ।
আমার বাবা এখনো মোবাইল থেকে ফোন করা ও ফোন রিসিভ ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। মোবাইল নিয়ে খুব একটা সময় ব্যয় করেনা বলেই এমন। বাবা বাসায় এলেই ডেকে বলবে আমার মোবাইলে নাম্বার সেভ করে দে।
আগের দিনে বেশির ভাগ মানুষ মোবাইলে নাম্বার সেভ করে রাখত না। সাথে ছোট একটি ডায়রি থাকতো সেই ডায়রিতে প্রয়োজনীয় সব নাম্বার লেখা থাকতো। আর এখন কার মোবাইলে কত গুলো নাম্বার সেভ করা আছে, কার মোবাইলের ফোনবুকে কত বেশি নাম্বার সেভ করা যায় সেই প্রতিযোগিতা। 

একটা সময়ে টিভিতে ফান করে দেখানো হতো অথবা কার্টুন আকা হতো ফকিরের হাতে মোবাইল, রিক্সা চালকের হাতে মোবাইল। কিন্তু এখন এই চিত্র বাস্তব। অনেক আগের কথা তখন সিটিসেল ২,৫০০শ'  টাকায় মোবাইল ফোন দিচ্ছে। যে কেউ মোবাইল কেনা শুরু করল। একদিন সিটিসেল কাস্টমার কেয়ারে যাই। একজন লোক পড়নে ছিল লুঙ্গি আর শার্ট। তার পায়ে স্যান্ডেল ছিল না। তার সমস্যা তার মোবাইল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে তা তিনি জানতে চান। তার অভিযোগ নতুন মোবাইল বন্ধ হয়ে যাবে এটা সে কিছুতেই মানতে পারছেন না। মানবেই বা কেন টাকা কী গাছে ধরে? ফাইজলামি পাইছে নাকি...। 

-স্যার আপনার সমস্যা কী?
-আমার মোবাইল বন্ধ হইয়া গেছে। 
-আপনার মোবাইলের সাথে যে চার্জারটা দেয়া হয়েছিল সেই চার্জার এনেছেন? 
-চার্জার আবার কী?
-চার্জার হলো যেটা দিয়ে মোবাইলে চার্জ দেয়া হয়। 
-ওইযে মোবাইলে সাথে যে একটা লম্বা তার দিছে সেইটা?
-হ্যা স্যার সেটা। সেটা দিয়ে মোবাইলে চার্জ দিতে হয়। চার্জ শেষ হলে মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। 
-চার্জ ক্যামনে দেয়? কাস্টমারের এমন উত্তরে কাস্টমার ম্যানেজার একটি চার্জার এনে তার মোবাইলে লাগিয়ে দেখিয়ে দিলো। 
-ও আইচ্ছা.....এইবার বুচ্ছি বলে লুঙ্গি পড়া লোকটা চলে গেল। 

আগে মোবাইল ফোন সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞ থাকলেও এখন সবাই সব বুঝে। কিভাবে গান শুনতে হয়,ছবি তুলতে হয়, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে হয় সব। বাজারে এক সময় যে কেউ সিম কিনতে পরেছে। ১৮ বছরের নিচে কারো কাছে সিম বিক্রির অনুমতি না থাকলেও বিক্রি হচ্ছে। পরিচয় গোপন করে, ছদ্দ নামে অথবা রেজিস্ট্রেশন ছাড়া সিম বিক্রি হয়েছে। এখনো যে হচ্ছে না তা না। এখন আগের চেয়ে একটু কঠিন হয়েছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, কথায় আছে টাকায় সব পাওয়া যায়। যে কারণে মোবাইল ফোনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ না করার মত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ছোট একটা কাহিনী দিয়ে মোবাইলের প্যাচাল শেষ করব।

২৬ বছর বয়সী এক যুবক। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে একটি মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়। মোবাইল ফোনে প্রথম যেদিন মেয়েটির সাথে ছেলেটির কথা হয় সেদিন থেকেই তাদের প্রেম শুরু। ভয়াবহ রকমের প্রেম একদিনেই তারা তাদের বিয়ে নিয়ে নানান রকমের পরিকল্পনা করে ফেলেছে। বাচ্চা নিবে বিয়ের পাচ বছরপর। মেয়েটা সেদিনই জানতে পারে ছেলেটা বিদেশ যাবে। একদিনেই মেয়েটার বায়না 'না তুমি বিদেশ যেতে পারবা না। তুমি বিদেশ চলে গেলে আমার কী হবে?' 
সারারাত কথা হয় দু'জনের। ছেলেটার উরু উরু ভাব। এখন সে আর অভাবে নাই। তারও প্রেমিকা আছে। এখন শুধু একটা এয়ারটেলের সিমের অভাব। কারণ, মেয়েটার এয়ারটেল নাম্বার আর ছেলেটার বাংলালিংক। এখন একটা এয়ারটেল সিম কার্ড কিনতে হবে। 
ছেলেটার পুরানো একটা এয়ারটেল নাম্বার আছে কিন্তু সিম কার্ডটা হারিয়ে গিয়েছে। তো এখন সিমটা উঠাতে হবে। ছেলেটা কাস্টমার কেয়ারে গেল। কাস্টমার কেয়ারে গেলে 'এফ এন এফ' নাম্বার জানতে চাইবে। ছেলেটা অনেক চিন্তা করে 'এফ এন এফ' নাম্বার মনে করে। পুরা মুখস্থ প্রশ্ন করলেই উত্তর দিবে বলে ঠিক করে।  

-স্যার, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? 
-আমার একটা সিম কার্ড হারিয়ে গিয়েছে। উঠাতে চাই।
-সিমটা কার নামে আছে স্যার?
-আমার নামেই আছে। 
-আপনার নাম?
-আমার নাম............
-আমরা দুঃখিত স্যার, সিমটা তো আপনার নামে নেই।
-কী কন সিমটা তো আমি-ই চালাইতাম। 
-না স্যার আপনার নামে তো নেই। 
-আমারে 'এফ এন এফ' নাম্বার জিগান? 
-না স্যার তা আর লাগবে না। আমরা সিম কার্ডটা আপনাকে দিতে পারছি না। 

উদাস মনে হতাশ ! হয়ে বেচারা খালি হাতে ফিরে আসে। মনে পড়ল যে সিম কার্ডটা যেখান থেকে কিনেছিল সেখান থেকে রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। দোকানদার অন্য নামে রেজিট্রেশন করেছে হয়তো। 
পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা হতাশা ভরা কন্ঠে বন্ধুকে বলল দোস্ত আমার সিম আমারে দিলো না। 'এফ এন এফ' নাম্বার মুখস্থ কইরা গেলাম তা জিগাইলই না। 
এদিকে একদিনে প্রেম হওয়া প্রেমিকার নাম্বারে ফোন করে নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। প্রতিদিন ট্রাই করতে করতে নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। খোলা থাকলেও ওয়েটিং পাওয়া যায় তারপর আবার বন্ধ......।

No comments:

Post a Comment