Thursday, August 20, 2015

ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লায় কিছু সময়

ফেসবুকের 'আনলিমিটেড আড্ডা' নামক গ্রুপ আড্ডা জমাতে গিয়েছিল লালবাগ কেল্লায় ফিরে এসে লিখেছেন রফিকুল ইসলাম সাগর 

অনেক ছোট থাকতে একবার লালবাগ কেল্লায় গিয়েছিলাম। অনেক বছর আগের কথা ঠিক মনে ছিল না মহাখালী থেকে লালবাগ কেল্লায় যাওয়ার সহজ পথ কোনটা। এক বড় ভাইয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী মহাখালী থেকে ৩ নম্বর বাসে উঠে শাহবাগ পর্যন্ত যাই। শাহবাগ মোড় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার রাস্তায় এক রিকশা চালককে বললাম, মামা লালবাগের কেল্লায় যাইবেন? যামু। কত? ৬০ টাকা। ৩০ টাকা দিমু। নাহ যামু না!

অন্য আরেকটি রিকশাচালককে বললাম। সে ৪০ টাকার কমে যাবেন না। এ রিকশাতেও উঠলাম না। আরেক জনকে বললাম। ৪০ টাকা ভাড়া চাইল। আমি বললাম, ৩০ টাকা। পরে ৩৫ টাকায় রিকশা ভাড়া করলাম। ঘড়ির কাটায় বিকেল ৩টা বেজে ৩০ মিনিট। যানজটহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রিকশা চলছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে পারিপার্শিক দৃশ্য আর ভিন্ন ভিন্ন মানুষ দেখছিলাম। রোদ মুক্ত ঠা-া পরিবেশ। মানুষের হইচই আর রিকশার ক্রিং ক্রিং হর্নের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। লালবাগ এলাকায় কেল্লার কাছাকাছি এসে ছোট রাস্তায় একটু জ্যামে আটকা পরি। পথচারি আর ছোট বড় গাড়ি মিলিয়ে লম্বা জ্যাম। দলে দলে মানুষ নানা সাজে সেজে কেল্লার পথে হেটে যাচ্ছে। সবার মুখে আনন্দের হাসি। চোখে দেখার আগ্রহ। দেখে বোঝা যাচ্ছিল এ মানুষগুলো লালবাগ কেল্লার দর্শনার্থী। জ্যাম ঠেলে রিকশা লালবাগ কেল্লার সামনের রাস্তায় পৌঁছল। সীমানার দেয়াল ঘেষে ছোট রাস্তা। বুঝতে পারলাম একটু সামনেই লালবাগ কেল্লা। বা পাশে অনেক উঁচু কেল্লার সীমানার দেয়াল। দেয়ালের উচ্চতা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আরও একটু লোহার শিক মিলিয়ে উচ্চতা। দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। কেল্লার মোট তিনটি গেট। সামনের দিকে দুইটি পেছনে একটি। লোহার বিশাল বড় এবং মজবুত রাজকীয় গেট ঘাড় উঁচু করে দেখতে হবে। দুইটি গেট সব সময় বন্ধ করে রাখা হয়। একটি গেট ব্যবহার হয় সকলের প্রবেশ এবং বাহির হওয়ার জন্য। এরই মধ্যে রিকশা মূল গেটের সামনে পৌঁছল। টিকিট কাউন্টারের সামনে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়। মানুষের পেছন থেকে এক পা দু পা এগিয়ে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে ভেতরে প্রবেশ করি।

ভেতরে প্রবেশ করেই সামনের দিকে বিবি পরীর সমাধি সৌধ দেখতে পেলাম। সামনের দিকে না এগিয়ে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম দর্শনার্থীদের চলাচল করার পথ, ভেতরের খোলা মাঠ সব কিছু খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য পথের দুই পাশে আকর্ষণীয় ফুলের গাছ। মাঠের ঘাসগুলো সবুজ সতেজ। ঘাসেও বিভিন্ন ডিজাইন করে ফুলের গাছ। শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধ সব বয়সের দর্শনার্থী মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ। কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছে, কেউ মাঠে বসে আড্ডা জমিয়েছে আবার কেউ কাউকে খুঁজছে। এদিক থেকে আমি কিছু ছবি তুলেনিলাম। সোজা সামনের পথে এগিয়ে গিয়ে দেখা হয় আনাস বিল্লাহ, আতাউর রহমান ও গাজী খায়রুল আলমের সঙ্গে। আড্ডা জমাতে ওরা আগেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। আমরা ক'জন মিলে একে একে সব কিছু ঘুরে দেখছিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সঙ্গে যোগ হয় আরও দুইজন সমুদ্র বিপ্লব ও সাইমুন সাদ। পেছন দিকটায় ছোট একটি লোহার গেটের সামনে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখতে পেয়ে এগিয়ে যাই সেখানে। এটি কেল্লার সুরঙ্গ পথ। এই পথ দিয়ে নাকি বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে যাওয়ার গোপন রাস্তা। তবে এখন আর এই পথ ব্যবহার করার সাহস কেউ করে না। এখান দিয়ে গেলে নাকি আর ফিরে আসা যায় না। কেউ যেন যাওয়ার চেষ্টা না করে তাই গেটে বড় আকারের তালা ঝোলানো। গেটের এপাশে দাঁড়িয়ে সুরঙ্গের ভেতরের দিকে উঁকি দিলে অন্ধকারে নিচের দিক নামানো ক'টি সিড়ি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। এটা দেখতেই মানুষের এতো কৌতুহল। এখানে দাঁড়িয়েই মূলত সবাই এই সুরঙ্গের ইতিহাস বলাবলি করে। ছোট শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে জানতে চায় এর ইতিহাস। এখান থেকে পশ্চিম পাশের মসজিদটি এক নজর দেখে এলাম। ভেতরে যাইনি। বাইরে থেকেই দেখলাম। কেল্লার পেছনে দক্ষিণ দিকে তিনটি গেটের আরেকটি গেট। এটিও এখন আর ব্যবহার হয় না। এই গেটটিই আমার চোখে সব চেয়ে সুন্দর মনে হয়েছে। এখনকার সময়ের নির্মাণ আর সেই আমলের নির্মাণ দেখে অবাক হতেই হয়। কত সূক্ষ্ম, প্রসংশনীয় পরিকল্পনা, দক্ষ কাজ ও মজবুত নির্মাণ। পূর্বপাশে গিয়ে একটি পুকুর দেখতে পাই। এটিতে একটু পানিও নেই। উপর থেকে নিচের গভীরতা দেখা যায়। ঘড়ির কাটায় বিকেল ৫টা। চারিদিক থেকে বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। দর্শনার্থীদের থাকার সময় শেষ। লালবাগ কেল্লার নিরাপত্তাকর্মীরা বাঁশি ফু দিয়ে দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে সবাইকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। খুব অল্প সময় তাই এখানে আর আড্ডায় বসা গেল না। তবে আমরা ঠিক করলাম আরেকদিন লালবাগ কেল্লায় আড্ডা করব। সেদিন সকাল সকাল চলে আসব। সবার সঙ্গে আমরাও একে একে বের হয়ে যাই। লালবাগ কেল্লা নিয়ে এই পর্যন্ত অনেক লেখা পড়েছি। একটু একটু করে জেনেছি। মোগল আমলে বাংলায় নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত লালবাগ কেল্লাটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পুরাকীর্তি। সতেরো শতকে বাংলায় মোগল শাসকদের শাসন মনোভাব, স্থাপত্য বিকাশের ঐতিহাসিক ক্ষেত্র এই লালবাগ কেল্লা।

ইতিহাসের পাতায় লালবাগ কেল্লার রূপকার হিসেবে শায়েস্তা খানের নাম পাওয়া গেলেও শায়েস্তা খান মূলত এই স্থাপনা নির্মাণকার্য শুরু করেননি। এটির নির্মাণের স্বপ্ন এবং সূচনা ঘটেছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আযম শাহের হাত ধরে। আযম শাহ ১৬৭৮-৭৯ সাল পর্যন্ত মাত্র এক বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। এই সময়টাতে তিনি বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী স্থানে তার পিতার নামানুসারে একটি স্থাপনা নির্মাণের কাজে হাত দেন। যার প্রথম নাম আওরঙ্গবাদ কিল্লা হলে পরবর্তীকালে লালবাগ কেল্লা নামে পরিণত হয়ে যায়। সুবাদার আযম শাহ লালবাগ কেল্লা নির্মাণ শুরু করলেও দিলি্ল থেকে জরুরি তলব আসায় ঢাকায় তিনি আর অবস্থান করতে পারেননি। তখন থমকে যায় লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কার্যটিও। তার অবর্তমানে ঢাকায় প্রেরিত নতুন সুবাদার শায়েস্তাখানকে তিনি আওরঙ্গবাদ কিল্লাটির অসম্পূর্ণ কার্য সম্পূর্ণ করার অনুরোধ করেন। শায়েস্তাখান আপন জামাতার এই নির্দেশনাকে বাস্তবায়ন করতে পারেননি তার বিশেষ পারিবারিক কারণে। এর পেছনে কয়েক ধরনের রটনা আছে। অনেকের মতে, এই আওরঙ্গবাদ কিল্লা বা লালবাগ কেল্লা নির্মাণের সময় শায়েস্তাখান তার কন্যা ইরান দুখতকে হারান। যিনি ছিলেন কেল্লা নির্মাণের প্রথম রূপকার আযম শাহের স্ত্রী। এ কারণেই শায়েস্তা খানের মনে বিশ্বাস জাগে কেল্লাটি একটি অপয়া স্থাপনা। সুতরাং তিনি অসম্পূর্ণ দুর্গটি নির্মাণে আর বেশিদূর অগ্রসর হননি। দুর্গ নির্মাণে শায়েস্তা খানের নিদারুণ অনাগ্রহ পর্যবেক্ষিত হলেও আপন কন্যা ইরান দুখতের মাজারকে তিনি দর্শনীয় স্থাপনা বানিয়ে তোলেন। মাজারটি নির্মাণের লক্ষ্যে শায়েস্তা খান ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাদা মার্বেল, ব্যাসল্ট, বেলে পাথরসহ আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ উপকরণ এনেছিলেন। আর এগুলোর সমন্বয়করণেই তৈরি হয়েছিল লালবাগ কেল্লার অন্যতম দর্শনীয় বিবি পরী বা ইরান দুখতের মাজারটি। এই মাজার ছাড়াও লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে রয়েছে গোসলখানা, একটি মসজিদ, পুকুর আর বাগান। পুরো বাংলার শাসনক্ষমতা মোগল সম্রাটের অধীনস্থ থাকলেও সম্রাট আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানের মেয়ের স্মৃতিস্বরূপ লালবাগ কেল্লাটিকে শায়েস্তাখানকে দান করে দেন। শায়েস্তাখানের পরবর্তী বংশধরেরা কেল্লাটিকে সরকারের কাছে লিজ দিয়ে বার্ষিক ৬০ টাকা করে পেতেন। পুরানা পল্টন থেকে ১৮৫৩ সালে সেনানিবাস পরিবর্তন করে এই লালবাগ কেল্লায় নিয়ে আসা হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের ক্ষেত্রেও এই কেল্লাটির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে কেল্লাটিকে একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এখতিয়ারে আছে। লালবাগ কেল্লায় প্রবেশ টিকিট মূল্য ১০ টাকা (বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য) ১০০ টাকা (বিদেশি নাগরিকদের জন্য)। 

লালবাগ কেল্লার গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) সময় সূচি হলো_ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যস্ত। আর শীতকালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। মাঝে ১ টা থেকে ত্রিশ মিনিটের মাধ্যাহ্ন বিরতি। শুক্রবারে মধ্যাহ্ন বিরতি থাকে ১২টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিটিন পর্যন্ত। রোববার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধদিবস এবং সব সরকারি ছুটির দিনগুলোতে লালবাগ দুর্গ বন্ধ থাকে। 

লালবাগ কেল্লা থেকে বের হয়ে আমরা ঠিক করলাম কিছুক্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সময় কাটাব। কোন রিকশা সেই পথে যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা হাটা শুরু করি। প্রায় পনের মিনিট হাটার পর সমুদ্র বিপ্লব আমাকে প্রশ্ন করল, এটা কোন জায়গা? আজিমপুর! আমি উত্তর দিলাম। বিপ্লব আবার বলল, ইডেন কলেজটা কোন দিকে? আনাস বিল্লাহ হাত উচিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে বলল, ওদিকে। ইডেন কলেজ অতিক্রম করে নিউমার্কেটের কাছে এসে বিপ্লব বলল, এবার সব চিনতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে পৌঁছতে আমাদের সময় লাগলো প্রায় এক ঘণ্টা। রাত ৯টার কাছাকাছি সময়ে এসে আড্ডা শেষ করি। তারপর যার যার নীড়ে ফেরা। 

No comments:

Post a Comment