Friday, December 25, 2015

বিদেশে ভিক্ষা

রফিকুল ইসলাম সাগর
আমাদের দেশে ভিক্ষুকরা হাত পেতে নির্লজ্জের মতো ভিক্ষা করে। কিন্তু বাইরের দেশগুলোতে ভিক্ষুকরা ভিক্ষা করে নানাভাবে তাদের প্রতিভা প্রকাশের মাধ্যমে পরিশ্রম করে। এতে মানুষ বিনোদন পায়, খুশি হয়ে তাদের টাকা দেয়। প্রথম যেদিন কুয়ালালামপুর গিয়েছিলাম, শহরের বুকিট বিনতাং নামক এলাকার ব্যস্ততম রাস্তায় এ রকম দৃশ্য দেখে অবাক হয়েছিলাম।

দেখতে পেলাম একটি স্থানে অসংখ্য মানুষ ভিড় করেছে। সেখানে ক'জন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। যে সুর আমার কানে ভেসে আসছিল, যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, তাদের ঘিরেই মানুষগুলোর ভিড়। সেখান থেকে আমি মোটামুটি দূরেই ছিলাম। বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে তাদের সৃষ্টি করা অসাধারণ সুর প্রথমে আমার কানে ভেসে আসে। এমন অসাধারণ সুর যা যে কাউকেই আকর্ষণ করবে। আমাকেও আকর্ষণ করল। আশপাশে তাকিয়ে যখন বুঝতে পারলাম সুরটা কোথা থেকে আসছে তখন এগিয়ে যাওয়ার সময় ভাবলাম, সম্ভবত মালয়েশিয়ান কোনো সেলিব্রেটি শিল্পীর কনসার্ট হচ্ছে। একেবারে কাছাকাছি গিয়ে যখন অন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে দাঁড়ালাম, তখন যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে তাদের সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। পাঁচ-ছয়জনের একটি দল। এদের মধ্যে একজন বাঁশি বাজাচ্ছে, একজন মাউথওর্গান বাজাচ্ছে, একজন বেহালা, একজন গিটার বাজাচ্ছে। খেয়াল করলাম এদের সবাই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। কারও পা নেই, হুইল চেয়ারে বসে বাজাচ্ছে। আবার কেউ অন্ধ। মনে মনে এদের সবাইকে স্যালুট জানিয়েছিলাম। কী দারুণ প্রতিভা তাদের। যারা সরাসরি দেখেননি তাদের বোঝানো আমার পক্ষে কষ্টকর। একজন হুইল চেয়ারে বসে ঘুরে ঘুরে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলছে। যার ইচ্ছা টাকা দিচ্ছে, কেউ আবার দিচ্ছে না। কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। পরে জানতে পারলাম, এটি মালয়েশিয়ায় ভিক্ষা করার পদ্ধতি। এখানে এত সহজে ভিক্ষা মেলে না। ভিক্ষুকরা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও নানা প্রতিভা প্রকাশ করে ভিক্ষা নেয়। কোনো কোনো ভিক্ষুক টিস্যু বিক্রি করে। কোনো ভিক্ষুক নিজ হস্তে বানানো জিনিসপত্র বিক্রি করে। এ ধরনের ভিক্ষুকদের কাছ থেকে যারা জিনিসপত্র কেনেন তারা জিনিসের প্রকৃত মূল্য দেওয়ার পাশাপাশি দয়া হলে অতিরিক্ত টাকা দান করেন। 
পুডু নামক একটি স্থানে প্রায়ই আমার চলাচল ছিল। সেখান থেকে আম্পাং নামক স্থানে (আম্পাং এলাকায় আমি থাকতাম) ফেরার সময় রেলস্টেশনে প্রবেশের রাস্তায় সবসময় দু'জন ভিক্ষুককে দেখতে পেতাম। দু'জনেই অন্ধ। বুড়াবুড়ি স্বামী-স্ত্রী। সবসময় দেখতাম তারা খালি গলায় কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গান গায়। দুটি ছোট ছোট সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে দূর থেকেও তাদের গান শুনতে পাওয়া যেত। যদিও গানের গলা খুব বাজে ছিল। শুনতে কেমন জানি লাগত। তবে বুড়াবুড়ি দু'জনকে দেখলে খুব মায়া হতো। কারও বয়স ৭০ বছরের নিচে হবে না। বয়সের ভারে দু'জনই নুইয়ে পড়েছেন। শরীরের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। বুড়ার দাঁত প্রায় সবই পড়ে গেছে। এই বুড়াবুড়ির চেহারা প্রায়ই আমার চোখে ভেসে ওঠে। বুড়িকে দেখতাম বসে বুড়ার কাঁধে একহাত রেখে মাথা নিচু করে গান গাইত। বুড়ার পরনে থাকত মালয়েশিয়ান পাঞ্জাবি (স্থানীয় নাম 'বাজুরায়া'), মাথায় টুপি। দু'জনের চোখে কালো চশমা।

No comments:

Post a Comment