Wednesday, March 11, 2015

প্রবাসে বিচিত্র অভিজ্ঞতা!

রফিকুল ইসলাম সাগর 
কুয়ালালামপুর শহরের আম্পাং এলাকায় একটানা দেড় বছর কাটিয়েছি। যে বাড়িটিতে ছিলাম তার সীমানা দেয়াল ঘেষে ছিল রেল লাইন। সকাল ৬টা থেকে রাত ১১.৩০ মিনিট পর্যন্ত প্রতি পাচ মিনিট পরপর ট্রেন যাওয়া-আসা করতো। বাড়ি থেকে বের হয়ে পায়ে হেটে রেল স্টেশন যেতে সময় লাগতো পাচ মিনিট। স্টেশনটির নাম আম্পাং 'এল আর টি'। মালয়েশিয়ার স্থানীয় ভাষায় ট্রেনকে বলা হয় এল আর টি। এ এলাকায় আমার প্রতিবেশীরা অধিকাংশই ছিল চাইনিজ এবং তামিল জাতি। পুরোপুরি আবাসিক এলাকা। অনান্য স্থানের তুলনায় বাড়ি ভাড়া একটু বেশি ছিল। আমার প্রতিবেশী এবং পার্শবর্তী দোকান রেস্টুরেন্টে কর্মরত যারা ছিল তাদের সাথে এতোটাই সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যে, চার-পাচ দিন দেখা না হলে যখন দেখা হতো জানতে চাইতো, অসুস্থ ছিলাম কিনা! নাকি কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলাম। 

বাড়ির পাশে একটি মুসলিম রেস্টুরেন্টে দিনে অন্তত একবার হলেও যেতাম। সাথে ল্যাপটপ নিয়ে গিয়ে বসতাম। খাবার খাওয়ার পাশাপাশি সেখানে ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। প্রতিদিন ১-৫ ঘন্টা অথবা তারচেয়ে বেশি সময় এখানে কাটিয়ে দিতাম। মালয়েশিয়ায় ছোট বড় প্রায় প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ফ্রি ওয়াইফাই আছে। হালাল খাবার ও হারাম খাবার দুই ধরনের রেস্টুরেন্ট আছে। নতুন কেউ মালয়েশিয়া বেড়াতে গেলে তাদের সুবিধার্তে বলে রাখি, প্রতিটি রেস্টুরেন্টে প্রবেশের সময় খেয়াল রাখবেন মূল ফটকে কোথাও না কোথাও ইংরেজিতে হালাল-হারাম শব্দটি লেখা থাকবে। দোকানকে মালয়েশিয়ার স্থানীয় ভাষায় 'কেদা' বলা হয়। খাবার দোকানকে বলা হয়, কেদা মাকান। মালাই ভাষা 'মাকান' শব্দের বাংলা অর্থ খাবার-খাওয়া।

ল্যাপটপ হাতে নিয়ে প্রতিদিনের মতো একদিন রাত আনুমানিক ১১টার সময় রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বের হই। রেস্টুরেন্টের কাছে যাওয়ার পর সবকিছু কেমন জানি অস্বাভাবিক মনে হলো। লক্ষ্য করলাম, মানুষ গুলোর দৃষ্টি মূল সড়কের দিকে। আমার কৌতুহল হলো, কি হয়েছে জানার। সড়কের প্রতিটি পয়েন্টে দেখলাম দু;তিনটি করে পুলিশের গাড়ি। গাড়ির উপরে লাল সাদা রঙের বাতি জলনিভু করছে। সড়কের কিছু অংশ চারদিক হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ফিতায় ঘেরা। যাতে কালো অক্ষরে লেখা POLICE LINE. এই ফিতার এপাশে উত্সুক জনতা দাড়িয়ে আছে। সড়কের একটি স্থানে সাদা রঙের একটি গাড়ি পাশে চার-পাচটি পুলিশের গাড়ি ও অসংখ্য পুলিশ দেখা যাচ্ছিল। জানলাম, সাদা গাড়িটির ভেতরে থাকা দুইজন যাত্রী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। সন্দেহজনক ভাবে পুলিশ প্রথমে গাড়িটিতে তল্লাশি চালায়। গাড়িতে পাওয়া যায় একটি অবৈধ পিস্তল। অবৈধ পিস্তল রাখার দায়ে পুলিশ দু;জন যাত্রীকে সাথে সাথে গুলি করে, এতে তারা নিহত হয়। মালয়েশিয়ার আইনে কারো কাছে অবৈধ পিস্তল পাওয়া গেলে পুলিশ স্পটে অবৈধ পিস্তল বহনকারীকে গুলি করে। স্থানীয় কারো কারো দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ ঘটনা সম্পর্কে আরো জেনেছিলাম, সেদিন অন্য একটি এলাকায় চেক পোস্টে পুলিশ সাদা গাড়িটিকে থামতে সিগনাল দিয়েছিল। গাড়ির চালক সিগনাল অমান্য করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে পালিয়ে যায়। চেক পোস্টের পুলিশ গাড়ির পিছনে তাড়া করতে থাকে। ওয়ারলেস ফোনের মাধ্যমে কন্ট্রোল রুমেও জানিয়ে দেয়। একপর্যায়ে আম্পাং এলাকায় পুলিশ চারিদিক থেকে সাদা গাড়িটিকে ঘিরে ফেলে। 

গুলি করার পরবর্তিতে পুলিশরা সড়কের নির্দিষ্ট কিছু অংশ ফিতা বেধে সিল করে দেয়, এবং তাদের উর্ধতন কর্মকর্তাদের স্পটে আসার জন্য অপেক্ষা করে। উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনা স্থলে এসে পরিদর্শন করে। গাড়ির ভেতরে থাকা লাশ, পিস্তল সহ যা কিছু যেভাবে ছিল সেভাবে পুলিশরা ভিডিও ফ্রুটেজ তৈরী করে। এ পুরো দৃশ্য দূর থেকে দেখছিলাম POLICE LINE লেখা ফিতার এপাশে দাড়িয়ে। সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা সংবাদকর্মীরাও দাড়িয়ে ছিল সাধারণ জনগনের সাথে ফিতার এপাশে। তারা ছবি তুলছিল ও ভিডিওচিত্র ধারণ করছিল দূর থেকেই যতটা সম্ভব। ফিতার ভেতরে পুলিশকর্মী ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। সকল ফর্মালিটি শেষে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ নিয়ে যায়। পরে পুলিশ ফিতা খুলে ফেলে, সড়কে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক হয়।  

আসামীকে তাড়া করে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা, প্রাইভেট কার থেকে নেমে পিস্তল তাক করে পুলিশের দাড়িয়ে থাকা, ঘটনাস্থল থেকে সাধারণ জনগণকে সরিয়ে দিয়ে POLICE LINE লেখা ফিতা বেধে নিরাপদ দুরত্ব নির্ধারণ করা, হলিউডের সিনেমায় দেখা এসব দৃশ্যের মতোই মনে হচ্ছিল আমার কুয়ালালামপুর পুলিশের এ অপারেশন। পরদিন সকালে এ সংক্রান্ত সংবাদ স্থানীয় প্রতিটি সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়। তবে কোথাও লাশের ছবি প্রকাশ হয়নি। কোনো কোনো পত্রিকা নিহতদের ফাইল ফটো প্রকাশ করেছিল।

No comments:

Post a Comment