Sunday, May 18, 2014

যান্ত্রিক নগর ছেড়ে...

শ্রীপুর ষ্টেশন 

রফিকুল ইসলাম সাগর 
শরীফ ভাই আগেরদিন বলে রেখেছিল গাজীপুর জেলার শ্রীপুর যাওয়ার কথা। পরেরদিন দুপুরে সে ফোন করে বলল, বিকেল সাড়ে চারটায় ট্রেন। তিনটের মধ্যে আমাদের স্টেশনে যাওয়ার জন্য বের হতে হবে। যথাসময়ে বিমান বন্দর স্টেশনে পৌছালাম। স্টেশনে অন্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি যাত্রীদের ভিড়। মে দিবস এবং দুইদিন সরকারী ছুটি মিলিয়ে একসাথে তিনদিন ছুটি পেয়ে সবাই নিজ নিজ গায়ে ফিরতে ভিড় করেছে। সবার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। এ আনন্দ আপন মানুষদের সাথে মিলিত হওয়ার। কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে ট্রেনের জন্য দশ মিনিট অপেক্ষা করতেই মাইকে ঘোষণা শুনতে পেলাম, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দেওয়ানগঞ্জ গামী জামালপুর কমিউটার স্টেশনে আসবে। মাইকে ঘোষণা শুনতে পেয়ে প্লাটফর্মের কাছে দাড়িয়ে ট্রেনে উঠার প্রস্তুতি নিলাম। কয়েক মিনিট পর জামালপুর কমিউটার স্টেশনে দাড়ালো।
টঙ্গী জংশনে ট্রেনের ছাদে 

ট্রেনের প্রতিটি বগিতে যাত্রীদের প্রচন্ড ভিড় দেখতে পেলাম। এই ভিড়ের ভেতরেই আরও যাত্রী ঠাসাঠাসি করে ট্রেনে উঠছে। শরীফ ভাই আমাকে বলল, কিরে কি করবি? কিভাবে যাবি? আমি বললাম, চলো ছাদে উঠি। শরীফ ভাই প্রথমে আপত্তি করলো। পরে দু'জনেই ট্রেনের ছাদের উপর উঠলাম। ছাদের উপরেও জায়গা নেই। কোনরকম চাপাচাপি করে বসলাম। ট্রেন ছাড়ল। প্রায় পনের মিনিট পর টঙ্গী জংশনে থামল। পাচ মিনিট অপেক্ষা করে এবার ট্রেন ছুটছে দুরন্ত গতিতে। প্রচন্ড বাতাসে খুব শান্তির অনুভুতি। সূর্যটা একটু একটু করে আড়ালে চলে যাচ্ছে। রোদের তাপ একেবারে নেই। এই ভিড়ের মধ্যেই ছাদের উপর হকাররা নানা রকমের খাবার বিক্রি করছে। কেউ ডিম, কেউ পান-সিগারেট, কেউ চানাচুর-সিঙ্গারা। হকার গুলো চলন্ত ট্রেনেই ছাদের উপর হেটে এক বগি থেকে অন্য বগি লাফিয়ে, কখনো বা ছাদের একবারে সাইড দিয়ে হেটে এসব বিক্রি করছে। দুর্ঘটনা ঘটার বিন্দুমাত্র ভয় নেই তাদের। ছাদের উপরেও একজন এলো টিকেট চেক করতে। এবার ট্রেনের গতি একটু একটু করে কমে গেল। বুঝলাম সামনেই স্টেশন ট্রেন থামবে সেখানে। 

জয়দেবপুর ষ্টেশন 

হ্যা ! জয়দেবপুর স্টেশনে থামলো। এখানে কিছু যাত্রী উঠলো। কিছু নামলো। তারপর আবার ট্রেন ছুটলো। কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন ভাওয়াল গাজীপুর স্টেশন অতিক্রম করলো। চলন্ত ট্রেন থেকে বাম দিকে গায়ের খোলা মাঠে মেলা দেখতে পেলাম। ক্ষনিকের দৃষ্টিতে রঙিন পোশাকে ছোট বড় অনেক মানুষ দেখতে পেলাম মেলায়। এছাড়া নাগর দোলা সহ আরো অনেক রকমের অস্থায়ী দোকান দেখতে পেলাম। 

রাজেন্দ্রপুর ষ্টেশন 

ঝক ঝক শব্দে ট্রেন চলছে। রেল লাইনের দু'পাশে সারি সারি গাছ। কখনো কখনো গাছের ডাল-পাতা শরীরে আঘাত লাগার আশংকায় মাথা উচু-নিচু করতে করতে করতে রাজেন্দ্রপুর স্টেশন অতিক্রম করলাম। এ রাস্তায় লাইনের দু'পাশে গাছের সংখ্যা আরো বেশি। একটু দূরে ঘন গজারী বন। বনের ভিতরে ইটের রাস্তা দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। তারকাটার বেড়া দিয়ে বন গুলোর সীমানা। কখনো আবার লাইনের দু'পাশে কলা বাগান, বাশ বাগান। কোথাও আবার খালি ময়দান, ধানক্ষেত, পুকুর এসব দৃশ্য হৃদয় বন্দী করে পৌছে গেলাম শ্রীপুর স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে আমি খুব আফসোস করলাম অনেক দ্রুত চলে এলাম বলে। ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের আনন্দটা একেবারে অন্যরকম। এডভেঞ্চার ভ্রমন। তবে ট্রেনের ছাদের উপর ভ্রমন ঠিক নয়। যেকোনো রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। 



শ্রীপুর স্টেশনের বাজারে একটি চায়ের দোকানে হাতমুখ ধুয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। গাইয়ের দুধের চা। শরীফ ভাই বলল, এখান থেকে বেশি কিছু খাবি না! সামনে গিয়ে তোকে একটি হোটেলে পুড়ি খাওয়াব। যা অনেক মজাদার। এমন মজাদার পুড়ি তুই আর কোথাও পাবি না। আর শ্রীপুর এসে এই হোটেলের পুড়ি না খেলে নাকি শরীফ ভাইয়ের এখানে আসাটাই বৃথা। সেই হোটেলের পুড়ি খেয়ে বুঝলাম ভাই এই পুড়ির এতো সুনাম কেন করল। অনেক মজাদার। পুড়ির ভেতরের মসলা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার শুধু পুড়ি-ই না পিয়াজু ও আলুরচপও মজাদার। এই হোটেলের বাইরে কোনো সাইন বোর্ড নেই, নাম লেখা নেই। একেবারে সাধারণ ভেতরে বসার জন্য তিনটি টেবিল। তারপরেও এখানে সব সময় ভিড়। তৈরী করার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়।

শ্রীপুর ষ্টেশন 


রাত যাপন করলাম শরীফ ভাইয়ের ফুফুর বাড়িতে। রাতে প্রচন্ড রকমের ঝড় এবং তার সাথে বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ সাথে ঠান্ডা আবহাওয়ায় ঘুম ভালো হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা শেষে গেলাম তাতিসুতা নামক গায়ে। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ১১টা। নতুন বাজার থেকে হেটে গায়ের পথে চললাম। মাটির কাঁচা পথ। একটু সামনের দিকে যেতেই দুপাশে দিগন্ত প্রসারী ঘন সবুজ ফসলের মাঠ। দখিনা বাতাসে দোল খায় সোনালী ধান খেত। কিছু কিছু ধান গাছ রাতের ঝড়ের আঘাতে শুইয়ে পরেছে। আরেকটু সামনে দেখতে পেলাম কৃষকেরা ধান গাছ থেকে ধান ঝাড়ছে। শরীফ ভাইদের গায়ের বাড়িতে ততক্ষণে চলে এলাম। বাড়ির একটু আগে পথে ছোট ছোট দুই-তিনটা আমগাছ চোখে পড়ল। যেগুলোতে আম ঝুলছে। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম উঠানে ধান শুকাতে দেয়া। সব গুলো মাটির ঘর। বাড়ির চারপাশ আম, কাঠাল, আমড়া, তাল, খেজুর গাছের ছায়ায় ঘেরা। আম গাছে আম, কাঠাল গাছে কাঠাল, খেজুর গাছে খেজুর, তাল গাছে ছোট ছোট তালের আঠি ঝুলছে। একটু পরে কাঁচা আম পারতে বাড়ির পিছনে গেলাম। শরীফ ভাই বাশ দিয়ে খুঁচিয়ে আম ফেলল আর আমি কুড়ালাম। আম পারা শেষে শরীফ ভাই বলল, বেল পারতে হবে। আমি সাথে গেলাম। আমি গাছে উঠার চেষ্টা করে কাটার জন্য উঠলাম না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে শরীফ ভাই বাশ দিয়ে খুঁচিয়ে একটি বেল নিচে ফেলল। 



এবার দুজনে দা হাতে নিয়ে নারিকেল বাগানে গেলাম। সেখানে গিয়ে পেলাম শরীফ ভাইয়ের চাচাতো ভাই ফরহাদকে। নারিকেল বাগানে নারিকেল গাছের পাশাপাশি আমের গাছও দেখা গেল। আমি ছোট একটি নারিকেল গাছে উঠলাম। কিন্তু ডাব পারতে পারলাম না। উপরে উঠেই শরীরে ক্লান্তি অনুভব করে নেমে পড়লাম। পরে ফরহাদ ছয়টা ডাব পারলো। আমরা ডাবের পানি পান করলাম। কিছুক্ষণ নারিকেল বাগানের ছায়ায় বসলাম। পাখিদের কিচির-মিচির, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাতাস মনে চরম শান্তি অনুভব করলাম। দুপুরে খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম শেষে এবার আবার যান্ত্রিক নগরে ফেরার পালা। এমন শান্ত-শ্যামল পরিবেশ ছেড়ে যদিও ফিরতে চাইছিল না মন তারপরেও....।


লেখা ও ছবি: রফিকুল ইসলাম সাগর 

No comments:

Post a Comment