Wednesday, April 22, 2015

সদরঘাট নৌ-টার্মিনালে একদিন

নগরজীবনে নৌ-চলাচল নেই বললেই চলে। তবে যারা অবসরে নৌকা ভ্রমণ করতে চান চলে যেতে পারেন সদরঘাট নৌ-টার্মিনালে। ভাড়া করা নৌকায় করে ঘুরতে পারবেন বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গায় নৌ-ভ্রমণ করে এসে লিখেছেন_ রফিকুল ইসলাম সাগর

নৌ লেখক বন্ধুদের সঙ্গে হাতিরঝিলে আড্ডা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছিল আগামী আড্ডা হবে সদরঘাট নৌ-টার্মিনালে। ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেল ৪টায় প্রায় আট বছর পর সদরঘাট এলাকায় গিয়ে কিছুই চিনতে পারছিলাম না। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম নৌ-টার্মিনাল কোনদিকে? লোকটি বলল সোজা গিয়ে বামে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রিকশা চলাচলের প্রচন্ড বেগ। রিকশা চালকেদের কোনো লাগাম নেই। পারলে শরীরের উপর দিয়েই রিকশা চালিয়ে নিয়ে যায়। দশ মিনিট রাস্তার এপাশে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি চলাচলের চাপ একটু কম দেখে ওপাশে পারাপার হই। পথে দেখতে পাই একটির পেছনে একটি সিরিয়ালে ঢাকার আদি যানবাহন ঘোড়ার গাড়ি। সদরঘাট এবং পুরান ঢাকার পথে সব সময়ই ঘোড়ার গাড়ির চলাচল দেখতে পাওয়া যায়।

রাস্তার ওপাশে গিয়ে লক্ষ করলাম অসংখ্য মানুষ। কারও হাতে কাপড়ের ব্যাগ, কেউ কেউ মাথায় কাপড় ও অনান্য জিনিসপত্র রাখার টিনের তৈরি 'ট্রাং' নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম এরা লঞ্চের যাত্রী। তাদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকি। কয়েক মিনিট হাঁটার পর একটু দূর থেকে দেখতে পাই সদরঘাট নৌ-টার্মিনালের মূল ভবন। সবার আগে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল নাদিম মজিদ। তাকে ফোন করে জানতে পারি সে টার্মিনালের ভেতরে পল্টুন নাম্বার ছয়-এর সামনে অবস্থান করছে। দুই নাম্বার টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখা হয় সমুদ্র বিপ্লব, মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ, সৈয়দ সিমান্ত ও খায়রুল কবিরের সঙ্গে। আড্ডার আহ্বানকারীদেরই লেট, তারা অভিযোগ করে। আরেক আহ্বানকারী সাইমুন সাদ তখনও এসে পৌঁছায়নি। তার মোবাইল নষ্ট তাই সে কোথায় আছে সেই তথ্য জানা সম্ভব ছিল না। তবে এটা নিশ্চিত ছিলাম যে সাদ আসবে। দুপুরে অফিস থেকে ফোন করে আমাকে জানিয়েছিল 'ভাই আমার মোবাইল নষ্ট। আমি যথা সময়ে সদরঘাট চলে আসব। এসে আপনাদের খুঁজে না পাওয়া গেলে দোকান থেকে ফোন করব।'

সমুদ্র বিপ্লব আমাকে প্রশ্ন করল ভাই, কীভাবে কী করবেন? প্লান কী? আমি বললাম টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করে নৌকা ভাড়া করে ঘুরব। আজকের আড্ডা হবে নৌকায়। আইডিয়াটা সবার খুব পছন্দ হয়। সাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে বিপ্লব বলেছিল, চলেন আমরা ভেতরে চলে যাই। নৌকায় উঠে সবার মোবাইল বন্ধ করে দেই। এরই মধ্যে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সাদ হাজির। কথা না বাড়িয়ে জনপ্রতি চার টাকা মূল্যের টিকিট কিনে নৌ-টার্মিনালের ভেতরে প্রবেশ করি। প্রথমেই চোখে পড়ল একটি ডিজিটাল টিভি স্ক্রিনের দিকে। টিভিটিতে লঞ্চ ছাড়ার এবং পৌঁছানোর সময় সূচি দেখা যায়। হেঁটে একটু সামনের দিকে যাওয়ার পর দেখতে পাই ঘাটে ছোট-বড় অসংখ্য লঞ্চ। কোন লঞ্চ মাত্র এসেছে, কোনটি ছাড়বে। যাত্রী উঠা-নামা করছে। আমরা হাঁটছিলাম, ছবি তুলছিলাম আর দেখছিলাম সেখানকার পরিবেশ, নানা কিসিমের মানুষ। তার সঙ্গে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এখানকার অসঙ্গতিগুলো। দেখতে পাই লঞ্চের কর্মীরা নারী যাত্রীদের যেভাবে তাদের লঞ্চে উঠার জন্য ডাকে তা পুরোপুরি ইভটিজিং। 

কেউ কেউ আমাদের লঞ্চের যাত্রী ভেবে ডাকছিল উঠেন উঠেন, বরিশাল বরিশাল, চাঁদপুর চাঁদপুর। যাত্রীদের সংখ্যা খুব একটা ছিলনা টার্মিনালে। কিছুটা ফাঁকা মনে হয়েছে। একটি নৌকার মাঝির কাছে জানতে চাইলাম, নৌকায় ঘুরব। ঘণ্টায় কত টাকা দিতে হবে? তিনি বললেন ঘণ্টায় দুইশ' টাকা। আমরা বললাম ঘণ্টায় দেড়শ টাকা দিব। দুই ঘণ্টায় তিনশ দিব। মাঝি রাজি হলেন না। সেখানে মাত্র একটি নৌকাই ছিল। সামনে আরও অনেক নৌকা আছে। আমরা বাজার যাচাই করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। দুইশ' টাকায় আড়াই ঘণ্টা অন্য আরেকটি নৌকার মাঝির সঙ্গে কথা ফাইনাল। একটি লঞ্চের পাশে নৌকাটি সাইড করা হলো। তিনতলা লঞ্চের নিচ তলা থেকে খানিকটা নিচে রাখা নৌকায় আমরা লাফিয়ে পরি। নৌকার দুলাদুলিতে ভয় পেয়েছিল যারা সাঁতার জানে না। মাঝি বলে দেয় কীভাবে বসতে হবে। মাঝির বৈঠার কেরামতিতে ভাসমান নৌকা আমাদের নিয়ে সামনের দিকে চলছে বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে। নদীর এদিকটায় অসংখ্য নৌকার চলাচল। আমাদের নৌকার পাশ কেটে যাচ্ছিল নৌকাগুলো। একেকটা নৌকায় ১০-১৫ যাত্রী। এসব যাত্রীরা নদীর এই পাড় থেকে ওই পাড়ে যাওয়ার জন্য নৌকা ব্যবহার করে। মাঝিকে নির্দেশ দেয়া হয় নৌকা ওপারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নৌকা পাড়ে রেখে আসাদ গেল বাদাম কিনতে। আসাদ বাদাম নিয়ে ফেরারপর মাঝি নৌকা ছাড়ল। 

নদী খুব শান্ত। ঢেউ খুব কম। এবার যেতে যেতে অনেকটা দূরে চলে যাই। অপরূপ সুন্দর দৃশ্য। যা নিমিষেই মনকে নিয়ে যায় ভাবনার গভীরে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় কল্পনার জগতে, বাড়িয়ে দেয় নতুন কিছু সৃষ্টির নেশা। আমি মনে করি আমাদের চারপাশের সব কিছুই সুন্দর। সুন্দর কিছু দেখতে হলে প্রয়োজন সুন্দর মন। কিছুক্ষণ পর পর একটি একটি করে লঞ্চ, স্টিমার ও ট্রলার আমাদের অতিক্রম করে যায়। এগুলো আমাদের অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ঢেউ এসে নৌকার দুলাদুলি বাড়িয়ে দিয়ে যায়। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম মাঝ নদীতে ক'টি বড় বড় জাহাজ ও লঞ্চ রাখা। এক পর্যায়ে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি আমাদের নিয়ে যায় সেই জাহাজ ও লঞ্চের কাছাকাছি। দূর থেকে শুধুই বড় মনে হয়েছে। কাছে গিয়ে অবাক হতে হয়েছে অনেক বড়। উপর থেকে শিকল দিয়ে নিচের দিকে ঝুলানো জাহাজের নোঙর ওরে বাবা! কি বিশাল বড়। একবার মনে হয়েছিল জাহাজের শিকলে ঝুলে ঝুলে বুড়িগঙ্গা নদীতে গোসল করি। কিন্তু নদীর পানি যেই নোংরা তা দেখে ইচ্ছা শুধু ইচ্ছাই রয়ে গেল। মাঝির কাছে জানতে পারি, এক একটি লঞ্চ নৌ-টার্মিনালের মূল ঘাটে অবস্থান করার সময় পায় আড়াই ঘণ্টা। যে লঞ্চ যখন ছাড়বে তার আড়াই ঘণ্টা পূর্বে মূল ঘাটে রাখা হয়। এর চেয়ে বেশি সময় যে লঞ্চ থাকে সেগুলো মূল ঘাট ছেড়ে অন্যত্র রাখা হয়। এমন কিছু লঞ্চ মাঝ নদীতে নোঙর করা অবস্থায় দেখতে পাই। নদীর এক পাড়ে দেখা যায় কিছু কিছু জাহাজের মেরামত কাজ চলছে। এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশে চলতে থাকে আমাদের গল্প আড্ডা। একেকজনের চরম হাস্যকর গল্পে অন্যজনের হাসতে হাসতে পানিতে পড়ার দশা। মাঝিও তার হাসি চেপে রাখতে পারল না। বৃদ্ধ বয়সের মাঝি বলে বসল, ভাতিজা তোমরা এই গল্প কোন বইয়ে পড়ছ? 

মাঝিকে প্রশ্ন করে জানতে পারি এ জায়গার নাম কালীগঞ্জ। অর্ধেক পানির নিচে অর্ধেক উপরে বালুবাহী একটি অনেক বড় স্টিমার। বালুবাহী এ স্টিমারগুলো চলন্ত অবস্থায় দেখলে মনে হয় ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু না এ স্টিমার এমনই। স্টিমারটি নৌকার দিকে আসতে দেখে মাঝি নৌকা কিনারায় চাপতে থাকে। আমরা যতই কিনারায় চাপছিলাম স্টিমারটিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমাদের দিকেই আসছিল। মাঝি বুদ্ধি খাটিয়ে নদীতে নোঙর করা বিশাল উঁচু জাহাজের সঙ্গে নৌকা চাপিয়ে দেয়। পাশাপাশি রাখা দুটি জাহাজটির সামনের দিকে নৌকাটি রাখায় অল্পের জন্য আমরা মারাত্মক দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পাই। নৌকার সঙ্গে স্টিমারটির আঘাত লাগলে নিশ্চিত নৌকা উল্টে আমরা পানিতে পড়তাম। এছাড়া শরীরেও আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা। তারপরেও অতিরিক্ত বেগে চলন্ত স্টিমারের একটু আঁচর লাগে নৌকায়। এতেই নৌকা দুলাদুলি করতে থাকে। তখন অতিরিক্ত যে ঢেউ দৃষ্টি হয়েছিল জাহাজের পাশে আশ্রয় নেয়াতে ঢেউয়ের চাপ আমাদের ক্ষতি করতে পারেনি। মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর অ্যাডভ্যানচার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম।

এবার সাদ বায়না ধরল নৌকা চালাবে। মাঝিও আপত্তি করল না। বৈঠা তার হাতে তুলে দিল। বৈঠা হাতে নিয়েই সে কেমন জানি কাঁপাকাঁপি শুরু করল, বৈঠা তার ওজনের চেয়ে ভারি কিনা। বৈঠা পানিতে নড়াচড়া করে নৌকা সামনের দিকে নেয়ার চেষ্টা। কিন্তু নৌকা সামনের দিকে না ভেসে ঘুরতে থাকে। নৌকা চালানো যে সহজ কাজ না বুঝতে পেরে সাদ মাঝির হাতে বৈঠা তুলে দেয়। বৈঠা হাতে নেয় সাদ। সে ঠিকই সুষ্ঠুভাবে বৈঠার কেরামতি দেখাতে পারল। নৌকা সামনের দিকেই যাচ্ছে। আসাদ বলল, আর কিছু পারি আর না পারি এই কাজ করে তো সংসার চালাইতে পারুম। জিনজিরার কাছাকাছি একটি পাইকারি বাজার ঘাটে নৌকা ভিড়ানো হলো। যাত্রা বিরতি! এ বাজারে সুপাড়ি, আমড়া, জলপাই ও চালতা বিক্রি হচ্ছে। পাইকাররা বস্তা ও টুকরি ভরা এ ফলগুলো নিয়ে বসে আছে। এত বড় আমড়া আমি এর আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না। আমড়ার কুড়ি ষাট টাকা।

এ বাজারে আমরা চা-বিস্কুট খেয়ে আবার নৌকায় উঠে বসি। যেদিক থেকে এসেছি উল্টো পথে আবার ফেরার পালা। কিছুক্ষণ পরই চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে যাবে। যতদূর দেখা যায় দোকানপাট ও বাসাবাড়ির ঘরে ঘরে ইতোমধ্যে বাতি জ্বলছে। দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগে আমরা আরও কিছু ছবি তুলে নিলাম। ছবিতে মুহূর্তগুলো আজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। নৌকা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আমাদের লেখা-লেখির নানা অভিজ্ঞতার গল্পসহ চলছিল আসাদুল্লার ১৮ প্লাস গল্প। যেতে যেতে আমাদের অবস্থান এক মুহূর্তে চীন-মৈত্রী সেতুর ঠিক নিচে। আমাদের বহনকারী নৌকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এ প্রথম দেখতে পাই সদরঘাট-গাবতলীর ওয়াটার বাস। তখন পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা ৭টা মাঝিকে বললাম, আমরা যেখান থেকে নৌকায় উঠেছি সেখানে নামিয়ে দিতে। নৌকা ছেড়ে উঠলাম লঞ্চের ছাদে। হইহল্লোর করে মাতিয়ে তুলেছিলাম চারপাশ। ঘড়ির কাঁটায় ৭টা বেজে ৩০ মিনিট। নৌ-টার্মিনাল থেকে বের হয়ে গেলাম। আইসক্রিম খেতে খেতে সিদ্ধান্ত হয় আগামী আড্ডা হবে লালবাগের কেল্লায়। আমরা কাউকে ব্যক্তিগতভাবে নিমন্ত্রণ করব না। ফেসবুকে আমাদের ঘোষণা দেখে যে কেউ আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিতে পারবে এমন সিদ্ধান্ত শেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে থাকি আমরা। চলতিপথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা চলতে থাকে পরস্পরের সঙ্গে। গুলিস্তান পর্যন্ত সবাই একসঙ্গে এসে বিচ্ছিন্ন হই। 


- See more at: http://www.sangbad.com.bd/old/index.php?ref=MjBfMTBfMDRfMTNfM18yN18xXzE0NDA0NQ%3D%3D#sthash.hcSQSU1S.dpuf

দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত (ঢাকা শুক্রবার, ১৯ আশ্বিন ১৪২০, ২৭ জিলক্বদ ১৪৩৪, ৪ অক্টোবর ২০১৩)

No comments:

Post a Comment