Wednesday, April 22, 2015

একদিন কুমিল্লায়

রফিকুল ইসলাম সাগর
রূপভানমুড়া

তখন ভোর সাড়ে ৫টা। মহাখালীর আমতলীতে আমরা চার বন্ধু হাজিরা দিলাম। মাইক্রোবাসের অপেক্ষায় থাকলাম। মুসল্লিরা নামাজ পড়ে ফিরছিলেন, স্বাস্থ্য উদ্ধারকারীও দেখলাম কয়েকজন। ৬টায় এলো মাইক্রোবাস। রাস্তা ছিল ফাঁকা। সোজা টানে গিয়ে থামলাম কুমিল্লার নূরজাহান হোটেলের সামনে। তিন ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগল। কুমিল্লার দুই বন্ধু আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল। নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম ইংরেজ কবরস্থানে। বইয়ে এর নাম ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি। কুমিল্লা-সিলেট সড়কের কোলঘেঁষে ময়নামতি সেনানিবাসের উত্তর পাশে এই কবরস্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনা ও বিমানবাহিনীর সৈনিকরা এখানে শায়িত আছেন। সব মিলিয়ে ৭৩৭টি কবর। প্রতিবছর ১১ নভেম্বর নিহতদের স্মরণে এখানে পালিত হয় 'রিমেম্বারেন্স ডে'। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়করা আসেন সেদিন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে শহীদদের গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা, তারপর ১ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
গেটের বাইরে থেকে ক্রুশ চিহ্নগুলো দেখা যাচ্ছিল। প্রতিটি কবরের মাথায় একটি করে ক্রুশ লাগানো। ভেতরে ঢুকে মৃদুমন্দ বাতাস পেলাম। খুব পরিচ্ছন্ন আর শুনশান চারিধার। কবরগুলো একই রকমভাবে বাঁধানো। ঘাসগুলো পরিপাটি করে কাটা। মনে হলো, কিশোরীর চিরুনি দেওয়া চুল। জানলাম, সৌধটির দুটি ভাগ। ক্রুশ চিহ্নগুলোর পেছনেই আছে মুসলিম সৈন্যদের সমাধি। জায়গাটি এত গোছগাছ করা যে মনে হলো বিদেশে আছি। প্রায় এক ঘণ্টা থাকলাম।
এরপর গেলাম বার্ড (বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট)। গাড়ি ভেতরে ঢোকানো যায় না, তবে কুমিল্লার বন্ধুরা থাকায় আমাদের গাড়ি ঢুকে পড়ল। বাংলায় এর নাম বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি। ঔষধি গাছগাছালির মাঝখান দিয়ে পিচ ঢালা আঁকাবাঁকা পথ। প্রকৃতি এখানে অবারিত। পাখিরা অনেক কথা বলছে। রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে থামলাম। সময় লাগল ১৫ মিনিট। কয়েক কদম হাঁটলাম। ইট-পাথরে গড়া ছাতার নিচে বসার জায়গা আছে। বিশাল উঁচু পানির ট্যাংকির কাছেই। কয়েক মিনিট জিরিয়ে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম পুকুরের ধারে। তবে পানি নেই। কিন্তু ইট বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নামা যায় অনেক দূর। তাই নেমে গেলাম। ওঠার সময় হাঁফ ধরে গেল। 

শালবন বিহার। ছবি : লেখক
এরপর গেলাম কোর্টবাড়ি এলাকায়। ইটাখোলা মুড়ার সামান্য পশ্চিমে সড়কের উল্টো দিকে গাড়ি থামিয়ে হেঁটে চললাম রূপভানমুড়া। প্রায় ২০ কদম যাওয়ার পর একটি সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম। সেটা পড়ে জানতে পারলাম, রূপভানমুড়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে একটি বিহার, একটি মন্দির, একটি ছোট কূপ ও একটি উঁচু মঞ্চ পাওয়া গেছে। আরো পাওয়া গেছে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর খৰ রাজা বলভট্টের মিশ্রিত ধাতুর চারটি মুদ্রা, তিনটি রৌপ্য মুদ্রা এবং গুপ্ত-পরবর্তী রীতিতে তৈরি একটি বেলে পাথরের বুদ্ধমূর্তি। অনেক পোড়া মাটির ফলকও পাওয়া গেছে। এসব প্রত্নসম্পদ বিচার করে ধারণা করা হয়, রূপভানমুড়া অষ্টম শতাব্দীর আগেই নির্মিত হয়েছে।
কিছু দূর গিয়ে লাল রঙের ইট নির্মিত মন্দিরটি দেখতে পেলাম। একনজরে চোখ জুড়ালো। মনে হলো, পয়সা উসুল। সিঁড়ি পেয়ে ভেতরে ঢুকলাম। তবে ভেতরে দেখার মতো কিছুই নেই। মূর্তি রাখার স্থান ফাঁকা। সামনে দিয়ে ঢুকে পেছনের দরজার সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে বের হলাম। এখানে ফিরে গেলাম ছোটবেলায়-মন্দিরের দেয়াল বানরের মতো বেয়ে একেবারে চূড়ায় উঠলাম। একে একে আমরা ছয়জনই। আশপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না, দু-একটি গরু ছাড়া। মন্দিরটি নির্মাণে ব্যবহার হয়েছে একেবারেই পাতলা ইট। এখন আর এমন দেখা যায় না। সেখান থেকে বেরিয়ে যাই শালবন বিহার। লালমাই পাহাড়ের মাঝে এ বিহার। ১০ টাকা মূল্যের টিকিট কিনতে হলো। দশ কদম সামনে এগিয়ে দেখতে পাই, ঘাস কেটে বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা-শালবন বিহার। পেছনে তালগাছ। জানলাম, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এখানে একটি বৌদ্ধবিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার আয়তন ১৬৭ বর্গমিটার। এতে মোট ১৫৫টি কক্ষ রয়েছে।

ওয়ার সিমেট্রি
ধারণা করা হয়, দেব বংশের চতুর্থ রাজা ভবদেব সপ্তম শতাব্দীর শেষে কিংবা অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে এটি নির্মাণ করান। এর মূল নাম ভবদেব মহাবিহার। আগে জায়গাটি শালবন রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল বলে খননের পরে এর নাম হয় শালবন বিহার।
বিহারের বেশির ভাগ অংশ মাটির নিচে। কিছুটা অংশ জমিনের ওপর উঁকি দিয়ে আছে। বিহারের চারপাশে অনেকটা খোলা জায়গা। সৌন্দর্য বাড়াতে নানা রকমের ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। শেষে সীমানার চারদিকে রাজকীয় দেয়াল।
প্রায় বিকেল হয়ে এলো। ভ্রমণ শেষ করলাম। কুমিল্লা রেলস্টেশনের কাছে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খেলাম। ইচ্ছা ছিল বিমানবন্দরটি দেখে নেওয়ার। কিন্তু যা হয়েছে, এক দিনের জন্য যথেষ্ট-ভেবে ক্ষান্ত দিলাম।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে তৃষা, এশিয়াসহ আরো কিছু পরিবহনের বাসে কুমিল্লা যাওয়া যায়। ভাড়া ১৫০-২৫০ টাকা। এক দিনের জন্য মাইক্রোবাস ভাড়া সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা।

- See more at: http://www.kalerkantho.com/feature/a2z/2015/01/19/176903#sthash.nxEcDCtP.dpuf

No comments:

Post a Comment