রফিকুল ইসলাম সাগর
মা ল য়ে শি য়া
সহজ সরল বোকা প্রকৃতির মানুষ আমিরুল। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার বীর খাগিয়ান গ্রামে তার বাড়ি। আজ থেকে ছয় বছর আগে গুলশানের এক দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া এসেছিলেন তিনি। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পরই তাকে আরেক চীনা দালালের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বলা যায়, অনির্দিষ্টকাল তাকে গোলামি করার জন্য বিক্রি করা হয়েছে। শুধু আমিরুল নন, তার সঙ্গে একই ফ্লাইটে আসা আরও ৪৩ জন বাঙালিকে সেই একই দালালের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ থেকে তাদের বেতন ১৮ হাজার টাকা দেয়া হবে বলা হয়েছিল, যা সেই সময়ে মালয়েশিয়া রিঙ্গিত প্রায় ১০০০। কিন্তু মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর তাদের বেতন নির্ধারিত হয় ৪৮৩ রিঙ্গিত। যা ছয় বছর আগে বাংলা টাকায় প্রায় ৮ হাজার ৬৯৪ টাকা ছিল (তখন মালয়েশিয়া ১ রিঙ্গিত বাংলা টাকায় ছিল ১৮ টাকার মতো)। বর্তমানে আমিরুলসহ আরও ১০২ জন বাঙালি সেই চীনা দালালের তত্ত্বাবধানে কাজ করছে। এদের সবার পাসপোর্ট চীনা দালালের কাছে। মালয়েশিয়া আসার পর থেকে পাঁচ বছর তাদের সবার বেতন ছিল ৪৮৩ রিঙ্গিত। গত বছর তাদের বেতন বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬২০ রিঙ্গিত।
দিনে ১২ ঘণ্টা ক্লিনারের কাজ করতে হয় আমিরুলদের। বর্তমানে মালয়েশিয়াতে ১২ ঘণ্টা কাজ করলে মাসে ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত থেকে ২ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত আয় করা যায়। আমিরুল যেখানে কাজ করে সেই একই জায়গায় পাকিস্তানি, নেপালি এবং ভারতীয়রা দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে ৫০ রিঙ্গিত আয় করছে। মাসে ৩০ দিন কাজ করলে হয় ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত, বাংলা টাকায় প্রায় ৩৯ হাজার টাকা (বর্তমানে ১ রিঙ্গিত বাংলা টাকায় ২৬ দশমিক ২২ টাকা)। আমিরুলের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ছয় বছরে একবারও দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার। দেশে যেতে কি ইচ্ছা করে না? আমার প্রশ্নের উত্তরে আমিরুল বলেন ‘ইচ্ছা তো করে, কিন্তু দালাল বই (পাসপোর্ট) দেয় না যে। তিনি আরও বলেন, দেশে যাইতে চাইলে ৩ হাজার রিঙ্গিত দালালের কাছে জমা দিয়া যাইতে অইব। বিমান ভাড়াও আমার বহন করতে অইব। এত কম টাকা আয় কইরা বিমান ভাড়া নিজে বহন করমু কেমনে?
আমিরুল বলতেই থাকেন, এছাড়া প্রতি মাসে বেতন পাইয়া দেশে বউ বাচ্চারে পাঠাইয়া দেই। দুই মাইয়্যা আমার। কিছুদিন আগে আমার অবর্তমানে আমার বড় মাইয়ার বিয়া হইছে। ৩ হাজার রিঙ্গিত জমা দিমু কইত্তে। ৩০০০ রিঙ্গিত জমা না রাখলে বই দিব না (পাসপোর্ট) দালালে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে চীনা দালালের তত্ত্বাবধানে আমিরুলরা কাজ করছে সেই দালাল প্রতি মাসে আমিরুলদের কর্মস্থল থেকে মাথাপিছু ১ হাজার ৮০০ রিঙ্গিত বেতন তুলছে। যার তিন ভাগের এক ভাগ পাচ্ছে আমিরুলরা। আর এ কারণেই কাজ শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমিরুলরা ঘরে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েন। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ নেই। কর্মস্থল আর ঘুমানো- এর বাইরে তাদের আর কোনো জীবন নেই। শুধু মালয়েশিয়া না বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশিরভাগ প্রবাসী বাঙালির জীবন কাহিনী প্রায় একই রকম। বেশির ভাগ মানুষ নিজের জমিজমা বিক্রি করে প্রবাসে যায়। প্রবাসে গিয়ে যখন তারা এরকম বিপদের সম্মুখীন হয় তখন তাদের সাহায্য করার জন্য কেউ থাকে না। বাধ্য হয়ে কষ্ট সহ্য করতে করতে এক সময় সব কিছু মানিয়ে নেন। জানি না কর্তৃপক্ষের তাদের জন্য কিছু করার আছে কি-না। প্রবাসে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ প্রতিকার পেয়েছে- এ রকম কথা এখনো কোনো মালয়েশিয়া প্রবাসীদের কাছে শুনিনি। যখন খুব কাছের মানুষের অসুস্থতার খবর পায় প্রবাসীরা তখন নিজের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে পারে না। কেউ মারা গেলেও তার লাশ দেখতে যেতে পারে না বাংলাদেশে। দেশের আত্মীয়স্বজনরা মনে করে বিদেশ গিয়ে স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে, ইচ্ছে করেই ফিরছে না, বিদেশে খুব আনন্দ করছে। কিন্তু চাইলেই যে ফেরা যায় না এই কথা কেউ জানে না। যখন কাউকে কর্মের জন্য প্রবাসে পাঠানো হয় তখন বেতন নির্ধারণ করা হয় এক রকম। কিন্তু প্রবাসে পৌঁছানোর পর তারা পায় নির্ধারিত বেতনের চেয়ে অনেক কম। যতটুকু জানি কর্তৃপক্ষের কাছে এরকম হাজার হাজার দালালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব দালালই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তি হচ্ছে না। গায়ের সহজ সরল মানুষ প্রবাসে যাওয়ার আগে সঠিক তথ্য যাচাই করছে না। তারা যাচাই করবেই বা কী করে? তারা যে অজ্ঞ!
মা ল য়ে শি য়া
সহজ সরল বোকা প্রকৃতির মানুষ আমিরুল। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার বীর খাগিয়ান গ্রামে তার বাড়ি। আজ থেকে ছয় বছর আগে গুলশানের এক দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া এসেছিলেন তিনি। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পরই তাকে আরেক চীনা দালালের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বলা যায়, অনির্দিষ্টকাল তাকে গোলামি করার জন্য বিক্রি করা হয়েছে। শুধু আমিরুল নন, তার সঙ্গে একই ফ্লাইটে আসা আরও ৪৩ জন বাঙালিকে সেই একই দালালের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ থেকে তাদের বেতন ১৮ হাজার টাকা দেয়া হবে বলা হয়েছিল, যা সেই সময়ে মালয়েশিয়া রিঙ্গিত প্রায় ১০০০। কিন্তু মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর তাদের বেতন নির্ধারিত হয় ৪৮৩ রিঙ্গিত। যা ছয় বছর আগে বাংলা টাকায় প্রায় ৮ হাজার ৬৯৪ টাকা ছিল (তখন মালয়েশিয়া ১ রিঙ্গিত বাংলা টাকায় ছিল ১৮ টাকার মতো)। বর্তমানে আমিরুলসহ আরও ১০২ জন বাঙালি সেই চীনা দালালের তত্ত্বাবধানে কাজ করছে। এদের সবার পাসপোর্ট চীনা দালালের কাছে। মালয়েশিয়া আসার পর থেকে পাঁচ বছর তাদের সবার বেতন ছিল ৪৮৩ রিঙ্গিত। গত বছর তাদের বেতন বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬২০ রিঙ্গিত।
দিনে ১২ ঘণ্টা ক্লিনারের কাজ করতে হয় আমিরুলদের। বর্তমানে মালয়েশিয়াতে ১২ ঘণ্টা কাজ করলে মাসে ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত থেকে ২ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত আয় করা যায়। আমিরুল যেখানে কাজ করে সেই একই জায়গায় পাকিস্তানি, নেপালি এবং ভারতীয়রা দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে ৫০ রিঙ্গিত আয় করছে। মাসে ৩০ দিন কাজ করলে হয় ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত, বাংলা টাকায় প্রায় ৩৯ হাজার টাকা (বর্তমানে ১ রিঙ্গিত বাংলা টাকায় ২৬ দশমিক ২২ টাকা)। আমিরুলের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ছয় বছরে একবারও দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার। দেশে যেতে কি ইচ্ছা করে না? আমার প্রশ্নের উত্তরে আমিরুল বলেন ‘ইচ্ছা তো করে, কিন্তু দালাল বই (পাসপোর্ট) দেয় না যে। তিনি আরও বলেন, দেশে যাইতে চাইলে ৩ হাজার রিঙ্গিত দালালের কাছে জমা দিয়া যাইতে অইব। বিমান ভাড়াও আমার বহন করতে অইব। এত কম টাকা আয় কইরা বিমান ভাড়া নিজে বহন করমু কেমনে?
আমিরুল বলতেই থাকেন, এছাড়া প্রতি মাসে বেতন পাইয়া দেশে বউ বাচ্চারে পাঠাইয়া দেই। দুই মাইয়্যা আমার। কিছুদিন আগে আমার অবর্তমানে আমার বড় মাইয়ার বিয়া হইছে। ৩ হাজার রিঙ্গিত জমা দিমু কইত্তে। ৩০০০ রিঙ্গিত জমা না রাখলে বই দিব না (পাসপোর্ট) দালালে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে চীনা দালালের তত্ত্বাবধানে আমিরুলরা কাজ করছে সেই দালাল প্রতি মাসে আমিরুলদের কর্মস্থল থেকে মাথাপিছু ১ হাজার ৮০০ রিঙ্গিত বেতন তুলছে। যার তিন ভাগের এক ভাগ পাচ্ছে আমিরুলরা। আর এ কারণেই কাজ শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমিরুলরা ঘরে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েন। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ নেই। কর্মস্থল আর ঘুমানো- এর বাইরে তাদের আর কোনো জীবন নেই। শুধু মালয়েশিয়া না বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশিরভাগ প্রবাসী বাঙালির জীবন কাহিনী প্রায় একই রকম। বেশির ভাগ মানুষ নিজের জমিজমা বিক্রি করে প্রবাসে যায়। প্রবাসে গিয়ে যখন তারা এরকম বিপদের সম্মুখীন হয় তখন তাদের সাহায্য করার জন্য কেউ থাকে না। বাধ্য হয়ে কষ্ট সহ্য করতে করতে এক সময় সব কিছু মানিয়ে নেন। জানি না কর্তৃপক্ষের তাদের জন্য কিছু করার আছে কি-না। প্রবাসে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ প্রতিকার পেয়েছে- এ রকম কথা এখনো কোনো মালয়েশিয়া প্রবাসীদের কাছে শুনিনি। যখন খুব কাছের মানুষের অসুস্থতার খবর পায় প্রবাসীরা তখন নিজের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে পারে না। কেউ মারা গেলেও তার লাশ দেখতে যেতে পারে না বাংলাদেশে। দেশের আত্মীয়স্বজনরা মনে করে বিদেশ গিয়ে স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে, ইচ্ছে করেই ফিরছে না, বিদেশে খুব আনন্দ করছে। কিন্তু চাইলেই যে ফেরা যায় না এই কথা কেউ জানে না। যখন কাউকে কর্মের জন্য প্রবাসে পাঠানো হয় তখন বেতন নির্ধারণ করা হয় এক রকম। কিন্তু প্রবাসে পৌঁছানোর পর তারা পায় নির্ধারিত বেতনের চেয়ে অনেক কম। যতটুকু জানি কর্তৃপক্ষের কাছে এরকম হাজার হাজার দালালের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব দালালই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তি হচ্ছে না। গায়ের সহজ সরল মানুষ প্রবাসে যাওয়ার আগে সঠিক তথ্য যাচাই করছে না। তারা যাচাই করবেই বা কী করে? তারা যে অজ্ঞ!


No comments:
Post a Comment