Tuesday, June 9, 2015

চট্টগ্রাম সিফিল বিচে একরাত

  • রফিকুল ইসলাম সাগর

বন্ধু মহলের আমরা আট জন এক মাস আগে থেকেই প্লান করছিলাম। পাভেল সেখানে পূর্বেই গিয়েছিল। ফিরে এসে পাভেল জায়গাটি সম্পর্কে আমাদের সবাইকে বর্ণনা দিয়ে সবার রাতের ঘুম নষ্ট করেদিয়েছিল। যতক্ষণ বন্ধু মহলে সবাই একসাথে আড্ডা দিতাম আলোচনার বিষয় ছিল চট্টগ্রাম সি ফিল বিচ। রাতে ঘুমাতে গেলে স্বপ্নে সি ফিল বিচে চলে যেতাম। পাভেল আমাদেরসবাইকে জায়গাটি সম্পর্কে অত সুন্দর বর্ণনা করেছিল যে আমরা সবাই রীতিমত মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম যেভাবেই হোক যেতেই হবে। সবাই রাজি। কিন্তু কিভাবে কী হবে। ইচ্ছে থাকলেও সবাই এক সাথে কোথাও যাওয়া হয় না। শেষ মুহূর্তে এসে কেউ না কেউ বাদ পড়ে যায়। এবার সবাই শপথ করলাম এক সাথে যাবই। 
সবাই মিলে দিন-সময় ঠিক করলাম। শেষ মুহুর্তে আমাদের যাত্রা করার নির্ধারিত দিনের দুই দিন আগে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ওদিকে মিজানের যাওয়ার জন্য টাকা জোগার হয়নি। সবাই ধরে নিয়েছে আমি আর মিজান যেতে পারব না। ১০৪ ডিগ্রী জ্বর ছিল আমার তারপরেও আগেরদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে আমি সৈকতের হাতে টাকা দিয়ে বললাম আমি যাব সবার সাথে আমার জন্যও বাসের টিকেট বুকিং দিয়ে রেখো। সৈকত বলল তোমার তো অনেক জ্বর। আমি বললাম কিছু হবে না চট্টগ্রাম গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার পরিবারের কাউকে আমি বুঝতে দেইনি যে আমি অসুস্থ। তারা জানলে এই অবস্থায় আমাকে যেতে দিবেনা। মিজান বাদে আমাদের সাত জনের বাসের টিকেট বুকিং করা হয়েছে। তখনও মিজান কনফার্ম করেনি যে সে আমাদের সাথে যাচ্ছে। 
আগেরদিন রাতে ব্যাগ গোছানো শুরু। সারারাত ঘুম হয়নি,খুব সকালে ঘর থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক হাটতে শুরু করলাম। মন খুব অস্থির, সময় কাটছে না। রাত ১১:৩০ মিনিটে ঢাকা সায়দাবাদ থেকে বাস ছাড়বে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সবার সাথে যোগাযোগ করতে থাকি। কে কখন বাহির হবে সেই খবর আদান-প্রদান চলছিল। বিকেলে সবাই একত্র হয়ে জানতে পারলাম মিজান আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। মিজান যাচ্ছে বলে সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম। রাত ৯টার সময় ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে সবাই যাত্রা করলাম সায়দাবাদ বাস টার্মিনালের পথে। 
যেই বাসটিতে যাবো সেই বাসে আমাদের সাত জনের আসন বুকিং করা। মিজানের জন্য এখন একটি টিকেট করতে হবে। কিন্ত আসন খালি নেই। অনেক আকুতি-মিনতি করে টিকেট মাস্টারকে রাজি করলাম। শর্ত ছিল মিজানকে আমাদের সাতজনের সাথে একটা ব্যবস্থা করে যেতে হবে। মিজান,মিরাজ আর রনি চাপাচাপি করে এক সাথে বসলো। যথাসময়ে বাসটি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। হইচই করে আমরা মাতিয়ে তুললাম পুরো বাস। রাতের ভ্রমন,সবাই ঘুমানোর চেষ্টা করছে। আমাদের হইচই করার কারণে অন্য যাত্রীরা বিরিক্ত হচ্ছে বুঝতে পারলাম। কিন্তু এই নিয়ে ভাবার সময় কী আমাদের আছে, আমদের হইচই চলতেই থাকলো। বাস ছুটে চলছিল তার আপন গতিতে। 
মধ্য পথে ২০ মিনিট যাত্রা বিরতিতে চা-নাস্তা খেয়ে নিলাম। রাত পেরিয়ে ভোরের আলো একটু একটু করে উকি দিয়ে যাচ্ছিল। পাখিরা সব কিচির মিচির করছিল ঠিক সেই সময় আমরাআগ্রাবাদ গিয়ে পৌছি। আগ্রাবাদ থেকে সি এন জি অটোরিক্সা ভাড়া করি ১৫ নাম্বার ঘাট যাওয়ার জন্য। পুরোপুরি নিরব একটি পরিবেশে অটোরিক্সা চলছিল। পথে মানুষের আনা গোনা খুব কম। ১৫ নাম্বার ঘাট যেতে সময় লেগেছিল ৩০ মিনিটের মত। ঘাট খুব ব্যস্ত,অসংখ্য নৌকা। মাঝিরা ডাক দিচ্ছিল আমার নৌকায় উঠেন। ঘাটে ভিড়ানো ছিল বিশাল বড় বড় জাহাজ-লঞ্চ। আরো দেখতে পেয়েছিলাম নৌ-বাহিনীর একটা অনেক বড় যুদ্ধ জাহাজ। এই জাহাজটি দিয়ে এখানে নৌ-বাহিনীরা সমুদ্র পথে নজরদারী করে বলে জেনেছিলাম। একটি নৌকায় উঠে বসলাম সমুদ্রের বুকে পারি দিয়ে ওপারে যাওয়ার জন্য। ওপারের ঘাটটি এই ঘাটে দাড়িয়েই দেখা যাচ্ছিল। খুব বেশি সময় লাগলো না সেখানে যেতে। যাওয়ার পথে মাহির সানগ্লাস পানিতে পড়ে গিয়েছিল। বেচারা মাহি দামী সানগ্লাস হারিয়ে খুব দুঃখ পেলো। সি ফিল যাওয়াটা অনেক কষ্টকর তাই অনেকেই যেতে চায় না। নৌকা থেকে নেমে আবার অটোরিক্সা ভাড়া করা হলো। এবার সরাসরি গৌন্তব্য সি ফিল বিচ। অটোরিক্সা থেকে নেমে গ্রামের ভিতর দিয়ে আকা-বাকা পথে হেটে গিয়ে অবশেষে দেখা মিললআমাদের এতদিনের স্বপ্নে দেখা সেই জায়গার। ঝাও বনের কাছে আছে কিছু দোকান। দোকানে পাওয়া যায় খাবারের অনেক কিছুই কিন্তু এই বিচে এবং আসে পাশে নেই থাকার কোনো ব্যবস্থা। শুধু মাত্র এই কারণে এখানে পর্যটকদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। আমরা যখন গিয়েছিআমরা আট জন ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাইনি। পূর্বে থেকেই ঠিক করেছিলাম একটি রাতআমরা বিচে কাটাব। বিচের পাশের দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যায় সন্ধা সাত টায়। একটি দোকানদার বলল আমাদের জন্য সে দোকান মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা রাখবে। দোকানদার আমাদেরকে কিছু চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিলেন। তাকে খুব খুশি মনে হচ্ছিল এক সাথে এতগুলো ক্রেতা পেয়ে। দুপুরে খাবার খেয়ে সমুদ্রের পাড়ে চেয়ারে বসে সমুদ্র দেখছিলাম। কেউ কেউ এদিক সেদিক হাটছিল। দুরে অনেক গুলো মালবাহী জাহাজ দেখতে পাচ্ছিলাম। বিকেল পেরিয়ে সন্ধা হয়ে এলো। লাল টকটকে সূর্যটা মুহুর্তেই গায়েব হয়ে গেলো,সে যেন সমুদ্রে ডুব দিলো। 
আর একটু পরেই সব দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা পুরো রাতের জন্য খাবার কিনে নিলাম। একে একে সব গুলো দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সমুদ্রের বিচে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। ভয়ংকর একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। দু'একটা কুকুর আসে পাশে ঘুর ঘুর করছিল। সেদিন পূর্নিমা থাকায় চাদের আলো বাতির আলোর মত আলোকিত করে রেখেছিল গোটা এলাকা। সবাই মিলে বালি খুড়ে বাবু ভাইকে বালির ভিতর চাপা দিলাম। দীর্ঘ সময় অভাবে আটকে রেখে তাকে মুক্তি দেয়ার পরই সে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল সমুদ্রের বুকে। তার সাথে আমরাও। মধ্য রাতে একটি বোতল দিয়ে ফুটবল খেলা শুরু হলো। এক মুহুর্তে রনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা খুব ভয় পেলাম। খোজা শুরু হলো রনিকে। দেখতে পেলাম রনি একটি জায়গায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। সবাই সেখানে বসে পড়লাম বালিতে। সবাই যেন নিজ নিজ ভাবনায় মগ্ন হয়ে পরলাম। সবাই চুপচাপ। নিরবতা। একজনকে খুব মনে পড়ছিল সেই মুহুর্তে আমার। সমুদ্রের গর্জন শোনা,আর সমুদ্রের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনা। রোমান্টিকতা অনুভব করছিলাম হৃদয়ের গভীরে। এভাবেই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজেকে নিয়ে। ভোর হওয়ার সাথে সাথেই আমরা কক্স-বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সাথে নিয়ে যাচ্ছিলাম ভয়ংকর পরিবেশে কাটানো একটি রাতের অভিজ্ঞতা। ভিন্নভাবে কাটানো কিছু স্মৃতি। 


২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৩, দৈনিক সংবাদের দূরে কোথাও পাতায় প্রকাশিত 

No comments:

Post a Comment