Monday, December 28, 2015

বট গাছে ভূত

রফিকুল ইসলাম সাগর
 
পাড়ার অনেকেই বলাবলি করে বাড়ীর পেছনের বট গাছটায় নাকি ভূত থাকে। প্রায় শত বছরের পুরোনো বট গাছটাকে দেখতেও একটা ভূতুরে ভাব আছে। গোটা বট গাছেই ফুটোর মতো অসংখ্য গর্ত। অনেকে বলে এই গর্ত গুলোতে সাপের বাসা। ছোট থাকতে আম্মাও এই বট গাছটাকে নিয়ে ভয় দেখাত। বট গাছের ওখানে একা একা যেতে নিষেধ করত। বলতো, বট গাছ থেকে ভূতে ধরবে, সাপে কামড়াবে। কথায় আছে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। আম্মার নিষেধ শুনতাম না, বট গাছটার আশেপাশেই বেশি ঘুরাঘুরি করতাম। বন্ধুরা মিলে বট গাছের ডালে দড়ি বেধে টারজানের মতো ঝুলতাম। আবার দোলনা বানিয়ে দোল খেতাম।  
বট গাছ ঘেষে যে রাস্তা তাতে দিনের বেলায়ই মানুষের আনাগোনা কম থাকে। আর রাতের বেলায় তো একেবারেই কমে যায়। চার-পাচ জন একসাথে হলে এই রাস্তা ব্যবহার করে, একা হলে বিকল্প রাস্তা দিয়ে যায়। বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করলে অনেক ঘুরে আসতে হয়। অনেকে সাহস করে একা বট গাছের রাস্তা ব্যবহার করেন। যারা করেন তারা মনে প্রচন্ড ভয় রেখে বট গাছ অতিক্রম করেন, বট গাছ অতিক্রম করে যেন শান্তির নিশ্বাস ফেলেন। মনে মনে বলেন আহ! বাচলাম। প্রায়ই দেখা যায় বট গাছের সামনে এসে অনেকে দৌড় দেন। বিশেষ করে দুপুরে ও রাতে এমন দৃশ্য দেখা যায়। আরেক শ্রেনীর লোক যারা কোনো কিছুকেই ভয় পাননা তারা রাস্তাটি ব্যবহার করেন। অনেকে রাতের বেলা দূর থেকে এ শ্রেনীর লোককে বট গাছের নিচ দিয়ে হেটে যেতে দেখেই ভূত যাচ্ছে ভাবেন।
বট গাছটিকে নিয়ে অনেক ভৌতিক ঘটনা শুনলেও আজ পর্যন্ত বট গাছে ভূত দেখিনি। ভূত খুজতেও গিয়েছি কিন্তু ভূল মামারা দেখা দেয়নি। ভূত মামারা মনে হয় শুধুমাত্র তাদের আসল ভাগিনাদেরই দেখা দেয়।
আমার বয়স যখন ১২-১৩ বছর। পাড়ার বড় ভাই ছোট ভাই মিলিয়ে পনের থেকে বিশ জনের গ্রুপ আমাদের। গোটা এলাকা দাঁপিয়ে বেড়াতাম। অনেক বেশি দুষ্টু ছিলাম। টইটই করে ঘুরে বেড়িয়ে ঘরে ফিরলেই শুনতাম, আম্মার কাছে পাড়ার লোকেদের দেয়া পাহাড় সমান বিচারের কথা। আম্মাকে খুব একটা ভয় পেতাম না, আম্মার কাছে জমা বিচারের পাহাড় এক ফুতেই গুড়িয়ে দিতাম। তখন আম্মা আব্বার কাছে বলার মিছে ভয় দেখাত তবে জানতাম এমন কাজ আম্মা করবে না। 
প্রতিদিন রাতেই কারেন্ট চলে গেলে চোর পুলিশ খেলতাম। এ খেলায় যারা চোর হতাম লুকাতাম বট গাছের আশেপাশের ঝোপে-ঝাড়ে। কেউ কেউ বট গাছের ডালেও উঠে লুকাত। যে পুলিশ হতো তার পক্ষে সবাইকে খুঁজে পাওয়া ছিল কষ্টকর। কারেন্ট না আসা পর্যন্ত সে শুধু খুজতই। 
একদিন গ্রুপের সবাই চোর-পুলিশ খেলার সময় প্লান করলাম, বট গাছের এখান দিয়ে রাতের বেলা যারা চলাচল করে তাদের ভয় দেখাব। আইডিয়াটি প্রথম বের হয়েছিল সিনিয়র জুয়েল ভাইয়ের মাথা থেকে। যেই কথা সেই কাজ। কিভাবে কি করব সব ঠিক করে ফেললাম। পরের দিন রাত দশটায় আমাদের ভয় দেখানোর মিশন। একে একে সবাই একত্র হলাম। একসাথে গেলাম বট গাছের দিকে। সাথে ঘর থেকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলাম পড়নের জন্য সাদা কাপড় আর বোতল ভর্তি পানি। চার-পাচ জন সাদা কাপড় পড়ে গাছে উঠলাম। আলাদা আলাদা ডালে বসলাম। হাতে পানির বোতল। বাকিরা সবাই পাশের ঝোপে-ঝাড়ে লুকিয়ে পড়ল মজা লুটবে বলে। এবার অপেক্ষা পথচারীর জন্য। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর ভয় দেখানোর জন্য মানুষ খুঁজে পেলাম। তিন-চারজন লোক বট গাছের নিচে আসতেই তাদের উদ্দেশ্য করে উপর থেকে পানি ছুড়ে মারলাম। পানি যখন তাদের উপরে পড়ল উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সাদা কাপড়ে ভূত বসে আছে আর সেকি দৌড়.... তা দেখে আমাদের হাসতে হাসতে গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার দশা। এরপরেই আরো দু'জন বট গাছের নিচ দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। তাদেরকেও উদ্দেশ্য করে পানি ছুড়ে মারার পর ইহ হি হি হি... করে হাসতে শুরু করলাম। দু'জনের একজন তো জুতা খুলেই দৌড়ালো। পরের দিন তাদের মাধ্যমে গোটা এলাকায় ছড়িয়ে যায় বট গাছে ভূত। তারা যখন আমাদেরকেই সেই ভূত দেখার অভিজ্ঞতা শোনালো তখন হাসি চাপিয়ে রাখা দায় হয়ে পরেছিল। ওদিনের পরে প্রায়ই আমরা এরকম ভয় দেখাতাম। সেই স্মৃতি গুলো প্রায়ই মনে করে করে হাসি। 


চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘প্রিয় লোহাগাড়া’ ম্যাগাজিন এর বিজয় দিবস সংখ্যা’ ১৫-তে প্রকাশিত 

No comments:

Post a Comment