Wednesday, January 13, 2016

স্কুল ম্যাগাজিন এবং স্বপ্ন ভঙ্গ

রফিকুল ইসলাম সাগর 


ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ের কথা। আমাদের স্কুল থেকে ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হবে, একদিন ক্লাস চলাকালীন এমন ঘোষণা দেয়া হলো। জানতে পারলাম, ম্যাগাজিনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত কিছুসংখ্যক লেখা ও আঁকা স্থান পাবে। এতে লেখা দিতে আগ্রহীদের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে লেখা/আঁকা জমা দিতে আহ্বান করা হলো। লেখা/আঁকা জমা দিতে হবে আবুল কাশেম স্যারের কাছে। ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য তিনিই লেখা নির্বাচিত করবেন। এ কাজে স্যারকে সহযোগিতা করতে গোটা স্কুল থেকে দুজন শিক্ষার্থীকে বাছাই করা হলো। ভাগ্যক্রমে সে দুজনের মধ্যে একজন ছিলাম আমি। আরেকজন আমারই সহপাঠী। তবে এখানে যে কথা না বললেই নয়, আমার মধ্যে বিশেষ কোনো প্রতিভা থাকায় যে স্যার আমাকে বাছাই করেছিলেন তা নয়। আসল ঘটনা হলো, স্যার তাকে সহযোগিতা করার জন্য ক্লাস নাইন থেকে দুজন শিক্ষার্থীকে নিবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তিনি যখন আমাদের ক্লাসে এসে প্রস্তাব দিলেন, ‘যারা আমাকে সহযোগিতা করতে চাও হাত উঠাও।’ স্যারের কথা শুনে আমি হাত উঠালাম। মনে করেছিলাম আরও অনেকেই হাত তুলবে। কিন্তু গোটা ক্লাসের মধ্যে মাত্র দুজন হাত তুলেছি। এমন চিত্র দেখে শুধু আমিই না, স্যারও অবাক হয়েছিলেন। আমি ছিলাম ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসা ক্যাটাগরির এবং প্রতিদিন পড়া না পারা টাইপের ছাত্র। আমার মাঝে এমন অসাধারণ(!) প্রতিভা থাকায় স্যার প্রথমে আমাকে নিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু ক্লাসের কোনো গুডবয়কে রাজি করাতে না পেরে আমার মতো ব্যাডবয়কে নিলেন বাধ্য হয়েই বলা চলে। আর আমিও যেন হাত উঠিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। 

স্যার আমাদের দুজনকে সাথে করে শিক্ষকরুমে নিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিলেন। তার পক্ষ থেকে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লেখা/আঁকা সংগ্রহ করার দায়িত্ব পেলাম আমরা। টিফিন টাইমে প্রতিটা ক্লাসে গিয়ে লেখা/আঁকা সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। কেউ কেউ নিজের লেখা জমা দেওয়ার জন্য আমার ক্লাসে আসছে। এসে যখন আমাকে খোঁজ করত তখন আমার ভাব দেখে কে! মজার ব্যাপার হলো ১ম, ২য়, ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও ওদের কচি হাতের লেখা/আঁকা জমা দেয়া শুরু করল। ওদের চোখে দেখতে পেতাম অন্যরকম আগ্রহ আর আনন্দ। ওদের মধ্যে কারও কারও লেখা/আঁকা ছিল বড়দেরও ভাবিয়ে তুলবার মতো। আমার এক বন্ধু সজীব প্রতিদিন একটি করে কবিতা জমা দিত। বিভিন্ন গান থেকে দুই কলি অথবা তিন কলি চুরি করে বন্ধু দশ লাইনের কবিতা লিখত।
লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি সবচেয়ে আনন্দ পেতাম যখন লেখা জমা দিতে এসে কেউ লেখা ম্যাগাজিনে ছাপানোর জন্য আকুতি-মিনতি করত, যেন লেখা নির্বাচন করার ক্ষমতা আমারই হাতে। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে তখন অনেক ক্ষমতাবান মনে হতো। প্রতিদিন সংগ্রহ করা লেখাগুলো স্কুল ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতাম। সপ্তাহে একবার সংগ্রহ করা সব লেখা/আঁকা একত্রে স্যারকে বুঝিয়ে দিতাম। এভাবে লেখা সংগ্রহের কাজ করলাম এক মাস। এই কাজ করতে গিয়ে নিজের মধ্যেও লেখক হওয়ার স্বপ্ন জেগে উঠল। আর তাই প্রতি সপ্তাহে সবার লেখার সাথে নিজের দু-চারটি লেখা ঢুকিয়ে দিয়ে স্যারের হাতে তুলে দিতাম। এক মাসে শুধু নিজের লেখাই জমা দিলাম কমপক্ষে ৫০টি। ধরে নিয়েছিলাম ম্যাগাজিনে আমার কমপক্ষে দশখানা লেখা তো প্রকাশ হবেই। আরও ভাবলাম, স্যারের জন্য কাজ করেছি সেই সূত্রে স্যার তো আমার লেখাগুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবেন এটা তো কনফার্ম। 


লেখা সংগ্রহ শেষে অতঃপর নির্বাচিত লেখা/আঁকা নিয়ে ম্যাগাজিন প্রকাশের কাজ শুরু হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ম্যাগাজিন সবার হাতে হাতে পৌঁছে যাবে। ম্যাগাজিন হাতে পাওয়ার চিন্তায় আমার রাতে ঘুম হয় না। অবশেষে একদিন ম্যাগাজিন হাতে পেলাম আর কি যে খুশি হলাম। অতি আগ্রহে প্রথম পাতা উল্টালাম, পরে দ্বিতীয় পাতা উল্টালামÑ একে একে শেষ পাতা পর্যন্ত দেখলাম। একি কেলেঙ্কারি কাণ্ড! আমার নাম কোথাও দেখতে পেলাম না। সম্ভবত আমার দেখতে ভুল হয়েছে, কোনো পাতা উল্টানোর সময় মনে হয় একসাথে দু-তিন পাতা উল্টিয়েছি এই ভেবে আবার শুরু থেকে পাতা উল্টিয়ে সূক্ষ্মভাবে দেখা শুরু করলাম। এবার হাতের আঙ্গুলে থুতু লাগিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলাম। শেষ পাতা পর্যন্ত আবারও দেখলাম কোথাও আমার নাম নেই। আবার মনে হয় দেখায় ভুল ছিল। নাহ! এবার মনে হলো, এই ম্যাগাজিনেই সমস্যা। অন্য আরেকটি ম্যাগাজিন নিলাম। তাতেও আমার লেখা তো দূরে থাক কোথাও আমার নামই নেই। আমার একটি লেখাও প্রকাশ হলো না, লজ্জায় মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়ল। অপমানে এবার বন্ধুদের সামনে নিজের মুখখানা করুণ-অসহায়ের মতো অনুভব করলাম। মুহূর্তেই যেন আকাশ থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লাম। কয়েকদিন পর এক চাচার বাসায় বেড়াতে গেলাম। সেখানে চাচি প্রশ্ন করলেন, স্কুল ম্যাগাজিনে তোমার লেখা কোনটা? চাচাতো বোন একই স্কুলে পড়ায় চাচির হাতেও পৌঁছে গিয়েছিল ম্যাগাজিন। চাচির প্রশ্নে আমার যেন কাটা ঘায়ে লবণ দেয়ার মতো জ্বালা লাগল।



No comments:

Post a Comment