রফিকুল ইসলাম সাগর
- See more at: http://www.kalerkantho.com/feature/a2z/2014/01/13/40829
দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত (১৩ জানুয়ারি, ২০১৪)
হঠাৎই রনি বলল, ভাই চলেন কুমিল্লা যাই। আমি বললাম নাহ! চল লঞ্চে করে চাঁদপুর যাই; এক লঞ্চে যাব, আরেক লঞ্চে ফিরব। রাজি হয়ে গেল রনি। মনিমেরও আপত্তি নেই। মহল্লার আড্ডায় উঠেছিল কথাটা। রাজীব ভাই, রানা আর শুভও দেখি তৈরি।
সন্ধ্যা তখন। প্রথমে যাই সদরঘাট। লঞ্চের টাইমটেবিল আর ভাড়ার খোঁজ নিতে গিয়ে মত পাল্টালাম। ঠিক করলাম বরিশাল যাব। রাজীব ভাই বললেন, ফাইনাল তো?
রাত সাড়ে ৮টায় লঞ্চ ছাড়বে। টার্মিনালের ভেতরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে লঞ্চের ছাদে গিয়ে বসি। লঞ্চ ছাড়লে মনটা হু হু করে উঠল। কত দিনের চেনা শহর পিছিয়ে পড়ছে! প্রচণ্ড বাতাস, তার মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার- আবেগে ভেসে গেলাম।
লঞ্চের হোটেলে রাতের খাবার খেতে গেলাম। একজনকে বললাম ভাত দিতে। সে আগেই বলল, ভাই হুদা আলু ভর্তা আর ডাইল দিয়া কইলাম ভাত বেচি না। আমরা নিজেদের আরেকবার দেখলাম, মনে কি হচ্ছে আমরা হুদা আলু ভর্তা আর ডাইল দিয়ে ভাত খাওয়ার পাবলিক! রেগে গিয়ে বললাম, ওই বেটা, তরে কইসি আলু ভর্তা আর ডাইল দিয়া ভাত খামু?
মামা চেইতেন না! অনেকে এমুন করে, এর লাইগা আগে কইয়্যা লই। তুই বেটা ভাত দে আগে, তারপর দেখিস কী দিয়া খাই, বলল রাজীব ভাই।
আমরা ছয়জনে বিশ প্লেট ভাত, ছয় প্লেট ইলিশ মাছ ভুনা, ছয় প্লেট গরুর গোশত আর বহুত আলু ভর্তা ও ডাল খেলাম। খাওয়া শেষ করে আবার লঞ্চের ছাদে উঠলাম। আমরা আর হাতে গোনা কজন যাত্রী বাদে বাকিরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিকে পানি। ঘরবাড়ি যাও দেখা যায়, অনেক দূরে। মনে হচ্ছিল লঞ্চ ভ্রমণের চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই।
ভোর ৫টায় বরিশাল পৌঁছালাম। গিয়ে শুনি কুয়াকাটা যেতে বেশি দিগদারি হবে না। বাই চড়ে গেল। রাজীব ভাই বললেন, এটাই ফাইনাল তো? কুয়াকাটার বাসে উঠলাম, সময় লাগল সাড়ে চার ঘণ্টা। ফেরি পারাপার হয়েছি তিনবার। সকালের নাশতা সেরেছিলাম কলাতলা ফেরিঘাটে। কুয়াকাটা পৌঁছানোর পরপরই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। সৈকতের কাছাকাছি ঝিনুক হোটেলে রুম বুক করি। তার আগে সমুদ্রে গোসল করার জন্য শর্ট-প্যান্ট কিনে নেই। তারপর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হয়ে যাই সমুদ্র দেখতে। কুয়াকাটা মাতাল করতে সময় নেয় না। কুয়াকাটা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত। কুয়াকাটাকে লোকজন আদর করে ডাকে সাগরকন্যা। বরিশাল বিভাগের শেষ মাথায় পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিণে এ সমুদ্রসৈকত। দৈর্ঘ্য ১৮ কিলোমিটার। যাঁরা নিরিবিলি সৈকত পছন্দ করেন তাঁদের জন্য কুয়াকাটা অদ্বিতীয়। সৈকতঘেঁষেই নারিকেলের সারি। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে শত শত মোটরসাইকেল দেখা যায়। চাইলে ভাড়া করে ঘোরা যায়। চালকের পেছনে বসে আশপাশের পনেরোটি স্পট ঘুরার প্যাকেজ পাঁচ শ টাকা।
আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম সমুদ্রে। বিকেল পর্যন্ত গোসল করে ঠাণ্ডা বাধিয়ে ফেলেছিলাম। রুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে সন্ধ্যায় বের হলাম খেতে। সমুদ্রে সাঁতার কেটে খুব ক্লান্ত ছিলাম, ক্ষুধাও পেয়েছিল খুব। খাবার খেয়ে আবার সতেজ হয়ে গেলাম। মনে হলো শরীর চার্জ দিয়েছি। প্রতি বেলায় আমাদের খাবারের মেন্যুতে ইলিশ মাছ ছিলই। এখানকার ইলিশ মাছের স্বাদ পুরোই আলাদা। আর মাছের পিসও বড় বড়। খাওয়া শেষে রুমে গিয়ে কার্ড খেলা শুরু করি। রাত ১০টায় সৈকতে যাওয়ার জন্য বের হতে গিয়ে জানলাম, রাত ১১টায় গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমরা ব্যাপারটা মানতে পারলাম না। অবশেষে দারোয়ানকে ম্যানেজ করে ফেললাম। তিনি অভয় মুদ্রা দেখিয়ে বললেন, আপনারা যখন ইচ্ছা আইসেন।
সৈকতে যাই। চারদিকে অন্ধকার, সুনসান। সমুদ্রের গর্জন বেড়েছে। মাঝে মাঝে ঝিঁঝি পোকার ডাক। এ রকম পরিবেশে শত কষ্টেও মন ভালো হয়ে যায়। সবাই একত্রে সৈকতের এক কোণে বসলাম। হইচই করে জাগিয়ে তুললাম পুরো সৈকত। একটু একা হতে আমি আড্ডা থেকে উঠে সৈকত ধরে হাঁটতে থাকলাম। একটু পর পর দূর থেকে সমুদ্রের পানি ঢেউয়ের সঙ্গে এসে আমার পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমি ভেসে যাই অচেনা কোনো লোকে।
পেছনে কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। তবে বন্ধুরা খুঁজতে খুঁজতে আমার কাছে চলে আসে। রাত প্রায় আড়াইটায় রুমে ফিরে আসি। ঘুমানোর আগে ঠিক করেছিলাম সকালে সূর্যোদয় দেখতে বের হব। তা আর হলো না। ঘুম থেকে উঠে দেখি দুপুর সাড়ে ১২টা। সবাইকে ডেকে তুললাম।
নাশতা করে সৈকতে যাই। আজ আর গোসল করলাম না। গতকাল ঝাঁপিয়ে ঠাণ্ডা বাধিয়ে ফেলেছি। সৈকতে ভাড়া করা ছাতার ছায়ায় শুয়ে আশপাশ দেখতে লাগলাম। কেউ কেউ সাগরবক্ষে আশ্রয় নিল। কেউ বালু নিয়ে খেলল।
বেলা ৩টায় আমরা সমুদ্র থেকে উঠে এলাম। এবার নীড়ে ফেরার তাড়া। ইচ্ছে নেই, কিন্তু ট্যাঁক খালি। ফিরে আসার সময় আপন মনে বললাম, আশাকরি আবার আসব। হোটেল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চললাম পটুয়াখালী। সবারই মনটা উদাস।
ছবি : মুস্তাফিজ মামুন
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা ৩২০ কিলোমিটার। সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাসটার্মিনাল থেকে সাকুরা, সুগন্ধা, মেঘনা বা আবদুল্লাহ পরিবহনের বাসে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। সময় লাগে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে প্রথমে পটুয়াখালী কিংবা কলাপাড়া যেতে হয়। তারপর ভাড়া করা মাইক্রোবাস অথবা পটুয়াখালী-কুয়াকাটা রুটের বাসে চড়ে যাওয়া যায় কুয়াকাটা।
- See more at: http://www.kalerkantho.com/feature/a2z/2014/01/13/40829
দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত (১৩ জানুয়ারি, ২০১৪)

No comments:
Post a Comment