রফিকুল ইসলাম সাগর
পৃথিবীর প্রাকৃতিক-সুন্দর রূপ কখনো নিজেই ধরা দেয় আমাদের কাছে, কখনো আবার দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড়, চা-বাগান, নদী, ঝর্না, মাজার শরিফ সব মিলিয়ে নৈসর্গিক রূপের রানী সিলেট। প্রকৃতির আদিম ও নিবিড় সানিধ্য অনুভব করার জন্য এখানে আছে বৈচিত্র্য ও আধুনিক সুন্দর জনপদ। আকাশভেদি পাহাড় ছলছল ঝর্ণাধারা বৈচিত্র্য সব দৃশ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায় রূপ কথার পাতায় পাতায়। সিলেট এই পর্যন্ত অনেকবার গিয়েছি তারপরেও মন ভরে না। সেখানে গেলে হৃদয়জুড়ে খুব শান্তি অনুভব করি।
কথা ছিল চারজন একসঙ্গে যাব। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণে আমি ঢাকায় আটকা পড়ে গেলাম। আগের দিন রাতে তামিম, নজরুল ও রাজীব ভাই রওনা করল সিলেটের উদ্দেশে। ঠিক হলো কাজ শেষ করে আমি পরের দিন বিকেলে সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করব। যেই কথা সেই কাজ, আমি তখনও ঢাকায় থাকলেও আমার মন-ধ্যান সব ছিল সিলেটেই। মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক করছিল কখন সিলেট গিয়ে পৌঁছাব। এদিকে তামিম ভাই ফোন করে করে আমার অবস্থান জেনে নিচ্ছিল। সায়েদাবাদ থেকে বিকেল ৪টায় বাসে উঠি। আগে থেকেই হালকা রকমের বৃষ্টি হচ্ছিল। বাসে উঠার পর বৃষ্টি আরও বাড়ল। যাই হোক বাসে উঠে নিশ্চিন্ত হলাম। তামিম ভাইকে ফোনে জানিয়ে দিলাম আমি বাসে উঠেছি। যথাসময়ে বাস ছাড়ল। ভাগ্য এতই ভালো ছিল যে বাসে যাত্রী সংখ্যা খুবই কম ছিল, আমার পাশের আসনটা ছিল খালি। আরাম করে বসার সুযোগ আর কী। চলতি পথে উজান ভাটি নামক রেস্টুরেন্টে ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতিতে বাস থামল। সেখানে নেমে হালকা নাস্তা করে নিলাম। ঘড়ির কাটায় রাত ৯টার সময় আবার বাস ছাড়ল। ধারণা করে নিলাম রাত ১১টা ২০ মিনিটে সিলেট গিয়ে পৌঁছাব। তামিম ভাই, আগে থেকে বলে রেখেছিল, শেরপুর অতিক্রম করার সময় যেন তাকে ফোন করি। তাহলে তারা বন্ধু পাভেলের বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাকে ঠিক সময়ে কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে রিসিভ করতে আসবে। পাভেলের বাড়ি সিলেটের বাঘবাড়ি নামক জায়গায়। আমি বাস থেকে নেমে কাউকে দেখতে পেলাম না। রাজীব ভাইয়ের মোবাইলে ফোন করলাম তিনি বললেন একটু কাজ থাকার কারণে তারা আসতে পারেনি। আমাকে বলা হলো বাঘবাড়ি পয়েন্ট চলে আসতে। রিকশা ভাড়া করে নিলাম। তখন সিলেটে সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে গোটা শহরে ছিল পোস্টার-ব্যানার। এছাড়া ছিল পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতিটি পারা মহল্লায়, অলিতে-গলিতে পুলিশ পহরা।
বাঘবাড়ি এলাকায় গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা হলো, আমাদের দলে যোগ হলো সিলেটের বন্ধু পাভেল, রুকসার ও তৌহিদ। পরের দিন খুব সকালে হজরত শাহ জালাল (র.) ও হজরত শাহ পরান (র.) মাজার জিয়ারতের উদ্দেশে বের হয়ে যাই আমরা। গোটা দিনের জন্য আমরা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে নিয়েছিলাম। মাজার জিয়ারত শেষে পূর্বের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা সালুটিকর বাজারের দিকে রওনা করি। প্ল্যান হয়েছিল সুরমা নদীর বুকে নৌকা ভ্রমণ করব। সালুটিকর বাজারের সুরমা নদীর তীরে আমাদের জন্য নৌকা নিয়ে মাঝি অপেক্ষা করছে। জিন্দাবাজার হয়ে বিমান বন্দর রোডে অটোরিকশা চলছে। পথের দুই পাশে ছোট ছোট পাহাড়, চা-বাগান। চলতি পথে একটি চা-বাগানের সামনে চালককে অটোরিকশা থামাতে অনুরোধ করলাম। যেই চা-বাগানটির সামনে নামলাম সেখানে লেখা চা-বাগানটি ১৮৮৪ সালের। অনেকে বলেন এই চা-বাগানটি নাকি সিলেটের প্রথম চা-বাগান। চা-বাগানের ভেতরের দিকে প্রবেশ করব ঠিক সেই মুহূর্তে একজন কাঁচি হাতে আমাদের সামনে হাজির। একটু ভয় পেলাম মনে হয়েছে সে আমাদের কাঁচি দিয়ে আঘাত করবে। কিন্তু না সে কাঁচি দিয়ে চা-গাছের আগাছা ছাটিয়ে দিচ্ছিল। লোকটি আমাদের বলল ভেতরে কমলা বাগান আছে দেখতে যাব কিনা। তাকে সঙ্গে নিয়ে কিছুক্ষণ বেড়ালাম। কিছুক্ষণ ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম। তারপর আবার ছুটে চলা। অতিক্রম করলাম পর্যটন মোটেল, সিলেট ক্যাডেট কলেজ। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পেছন দিয়ে সালুটিকর বাজার যাওয়ার রাস্তাটি রানওয়ের শেষ সীমানা ঘেঁষে, যাওয়ার সময় দেয়ালের ওপর দিয়ে পুরো বিমান বন্দর এবং রানওয়ে দেখা যায়। সেই পথ দিয়ে আমরা যাওয়ার ঠিক সেই মুহূর্তে একটি বিমান অবতরণ করল। দৃশ্যটা খুব চমৎকার ছিল। একটু সামনে গিয়েই দেখতে পেলাম অনেক উঁচু পাহাড়, এই পথে এটি-ই সব চেয়ে উঁচু পাহাড়। তার একটু সামনে দেখতে পেলাম পাথরের বাজার, সেখানে পাথর কেনা-বেচা হচ্ছে, মেশিনে পাথর ভাঙা হচ্ছে। এই পাথরগুলো এখানে আনা হয় ভোলাগঞ্জ থেকে। ভোলাগঞ্জ পাথরের দাম জাফলং থেকে অনেক সস্তা। সালুটিকর বাজারের একটু আগে সুরমা নদীর ঘাট। সবাই অটোরিকশা থেকে নেমে পরলাম। ঘাটে কয়েকটি স্টিমার ও লঞ্চ দেখতে পেলাম। আমরা চা-পান করে নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকায় করে গন্তব্য গোয়াইন ঘাট। নদী পুরোপুরি শান্ত। আকাশ দেখে মনে হয়েছে বৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। প্রায় ঘণ্টা খানেক হলো আমাদের বহনকারী নৌকা সুরমা নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। পাশ দিয়ে দু'একটি ট্রলার যাচ্ছিল নিজ নিজ গন্তব্যে। দূরে দেখা যাচ্ছিল আকাশভেদি পাহাড়। তার সঙ্গে দেখা যাচ্ছিল ঝর্নার পানি গড়িয়ে মাটিতে পরার দৃশ্য। কিন্তু বিরাট আফসোস! এই পাহাড় ও ঝর্নাগুলো ভারতের সীমান্তের ভেতর। তাই কাছে না গিয়ে দূর থেকে দেখতে হয়েছে। কী যে অপুরূপ সৌন্দর্যের মাঝে সময় কাটাচ্ছিলাম। নেই কোন ক্লান্তি, চিন্তা, ভয়, শাসন-বারণ। নদীর পানিতে শরীরখানা একবার ভেজানোর জন্যও মরুভূমি হয়ে ছিল বুকের উষ্ণ জমিনটুকু। এক পাশে নৌকা ভিড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম নদীর বুকে। হটাৎ করে আকাশ মেঘলা হয়ে এলো।
মেঘলা আকাশ! আমরা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলাম না। নৌকায় আবার সালুটিকর বাজার ফিরে এলাম। সুরমা নদীর বুকে থাকার সময় ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল, তবে ভয় পাইনি। সিলেট এমনই এই বৃষ্টি এই রোদ। সালুটিকর বাজার পৌঁছার পর পরই বৃষ্টি ঝড়ে রূপ নিলো। আমরা আশ্রয় নিলাম গ্রামের একটি বাড়িতে। সবগুলো ঘর মাটি দিয়ে তৈরি। বাড়ির চারিদিকে নানা রকমের গাছ-গাছালি। একটি ঘরের সামনে আমরা তালপাতার পাটি বিছিয়ে বসে পড়লাম। মনের আনন্দে গান করছিলাম। প্রচ- বাতাসে গাছগুলো দুলছিল, মনে হয়েছে গাছগুলো এখনই ভেঙে পড়বে। বাড়ির মানুষগুলো খুব ভালো, তাদের একজনকে বাজার করার টাকা দিয়ে বলেছিলাম আমাদের জন্য রান্না করার জন্য। ঘুরার নেশায় দুপুরে খাবারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বৃষ্টির মুহূর্তে মাটির বাড়িতে আশ্রয় আমাদের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই ঠিক তখন পেটে দানা-পানি পড়ল। রাতে সিলেট শহরে ফিরে এলাম। পরের দিন কেটেছে সিলেট শহরেই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে। এক মুহূর্তে সময় হয়ে এলো প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যাওয়ার। অদেখা, অধরা, অজানা থেকে গেল অনেক কিছু। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে জানালা দিয়ে আরও একবার চোখ রাখলাম বাইরের দিকে। রাতের স্টেশনের পরিবেশ তখন খুব মায়াবী মনে হয়েছে। এক ঝলক টাটকা বাতাস যেন বয়ে গেল মনের উপর দিয়ে। ট্রেনের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল সিলেট রেল স্টেশন।
দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত (ঢাকা শুক্রবার, ৪ শ্রাবণ ১৪২০, ৯ রমজান ১৪৩৪, ১৯ জুলাই ২০১৩)
পৃথিবীর প্রাকৃতিক-সুন্দর রূপ কখনো নিজেই ধরা দেয় আমাদের কাছে, কখনো আবার দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড়, চা-বাগান, নদী, ঝর্না, মাজার শরিফ সব মিলিয়ে নৈসর্গিক রূপের রানী সিলেট। প্রকৃতির আদিম ও নিবিড় সানিধ্য অনুভব করার জন্য এখানে আছে বৈচিত্র্য ও আধুনিক সুন্দর জনপদ। আকাশভেদি পাহাড় ছলছল ঝর্ণাধারা বৈচিত্র্য সব দৃশ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায় রূপ কথার পাতায় পাতায়। সিলেট এই পর্যন্ত অনেকবার গিয়েছি তারপরেও মন ভরে না। সেখানে গেলে হৃদয়জুড়ে খুব শান্তি অনুভব করি।
কথা ছিল চারজন একসঙ্গে যাব। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণে আমি ঢাকায় আটকা পড়ে গেলাম। আগের দিন রাতে তামিম, নজরুল ও রাজীব ভাই রওনা করল সিলেটের উদ্দেশে। ঠিক হলো কাজ শেষ করে আমি পরের দিন বিকেলে সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করব। যেই কথা সেই কাজ, আমি তখনও ঢাকায় থাকলেও আমার মন-ধ্যান সব ছিল সিলেটেই। মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক করছিল কখন সিলেট গিয়ে পৌঁছাব। এদিকে তামিম ভাই ফোন করে করে আমার অবস্থান জেনে নিচ্ছিল। সায়েদাবাদ থেকে বিকেল ৪টায় বাসে উঠি। আগে থেকেই হালকা রকমের বৃষ্টি হচ্ছিল। বাসে উঠার পর বৃষ্টি আরও বাড়ল। যাই হোক বাসে উঠে নিশ্চিন্ত হলাম। তামিম ভাইকে ফোনে জানিয়ে দিলাম আমি বাসে উঠেছি। যথাসময়ে বাস ছাড়ল। ভাগ্য এতই ভালো ছিল যে বাসে যাত্রী সংখ্যা খুবই কম ছিল, আমার পাশের আসনটা ছিল খালি। আরাম করে বসার সুযোগ আর কী। চলতি পথে উজান ভাটি নামক রেস্টুরেন্টে ২০ মিনিটের যাত্রা বিরতিতে বাস থামল। সেখানে নেমে হালকা নাস্তা করে নিলাম। ঘড়ির কাটায় রাত ৯টার সময় আবার বাস ছাড়ল। ধারণা করে নিলাম রাত ১১টা ২০ মিনিটে সিলেট গিয়ে পৌঁছাব। তামিম ভাই, আগে থেকে বলে রেখেছিল, শেরপুর অতিক্রম করার সময় যেন তাকে ফোন করি। তাহলে তারা বন্ধু পাভেলের বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাকে ঠিক সময়ে কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে রিসিভ করতে আসবে। পাভেলের বাড়ি সিলেটের বাঘবাড়ি নামক জায়গায়। আমি বাস থেকে নেমে কাউকে দেখতে পেলাম না। রাজীব ভাইয়ের মোবাইলে ফোন করলাম তিনি বললেন একটু কাজ থাকার কারণে তারা আসতে পারেনি। আমাকে বলা হলো বাঘবাড়ি পয়েন্ট চলে আসতে। রিকশা ভাড়া করে নিলাম। তখন সিলেটে সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে গোটা শহরে ছিল পোস্টার-ব্যানার। এছাড়া ছিল পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতিটি পারা মহল্লায়, অলিতে-গলিতে পুলিশ পহরা।
বাঘবাড়ি এলাকায় গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা হলো, আমাদের দলে যোগ হলো সিলেটের বন্ধু পাভেল, রুকসার ও তৌহিদ। পরের দিন খুব সকালে হজরত শাহ জালাল (র.) ও হজরত শাহ পরান (র.) মাজার জিয়ারতের উদ্দেশে বের হয়ে যাই আমরা। গোটা দিনের জন্য আমরা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে নিয়েছিলাম। মাজার জিয়ারত শেষে পূর্বের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা সালুটিকর বাজারের দিকে রওনা করি। প্ল্যান হয়েছিল সুরমা নদীর বুকে নৌকা ভ্রমণ করব। সালুটিকর বাজারের সুরমা নদীর তীরে আমাদের জন্য নৌকা নিয়ে মাঝি অপেক্ষা করছে। জিন্দাবাজার হয়ে বিমান বন্দর রোডে অটোরিকশা চলছে। পথের দুই পাশে ছোট ছোট পাহাড়, চা-বাগান। চলতি পথে একটি চা-বাগানের সামনে চালককে অটোরিকশা থামাতে অনুরোধ করলাম। যেই চা-বাগানটির সামনে নামলাম সেখানে লেখা চা-বাগানটি ১৮৮৪ সালের। অনেকে বলেন এই চা-বাগানটি নাকি সিলেটের প্রথম চা-বাগান। চা-বাগানের ভেতরের দিকে প্রবেশ করব ঠিক সেই মুহূর্তে একজন কাঁচি হাতে আমাদের সামনে হাজির। একটু ভয় পেলাম মনে হয়েছে সে আমাদের কাঁচি দিয়ে আঘাত করবে। কিন্তু না সে কাঁচি দিয়ে চা-গাছের আগাছা ছাটিয়ে দিচ্ছিল। লোকটি আমাদের বলল ভেতরে কমলা বাগান আছে দেখতে যাব কিনা। তাকে সঙ্গে নিয়ে কিছুক্ষণ বেড়ালাম। কিছুক্ষণ ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম। তারপর আবার ছুটে চলা। অতিক্রম করলাম পর্যটন মোটেল, সিলেট ক্যাডেট কলেজ। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পেছন দিয়ে সালুটিকর বাজার যাওয়ার রাস্তাটি রানওয়ের শেষ সীমানা ঘেঁষে, যাওয়ার সময় দেয়ালের ওপর দিয়ে পুরো বিমান বন্দর এবং রানওয়ে দেখা যায়। সেই পথ দিয়ে আমরা যাওয়ার ঠিক সেই মুহূর্তে একটি বিমান অবতরণ করল। দৃশ্যটা খুব চমৎকার ছিল। একটু সামনে গিয়েই দেখতে পেলাম অনেক উঁচু পাহাড়, এই পথে এটি-ই সব চেয়ে উঁচু পাহাড়। তার একটু সামনে দেখতে পেলাম পাথরের বাজার, সেখানে পাথর কেনা-বেচা হচ্ছে, মেশিনে পাথর ভাঙা হচ্ছে। এই পাথরগুলো এখানে আনা হয় ভোলাগঞ্জ থেকে। ভোলাগঞ্জ পাথরের দাম জাফলং থেকে অনেক সস্তা। সালুটিকর বাজারের একটু আগে সুরমা নদীর ঘাট। সবাই অটোরিকশা থেকে নেমে পরলাম। ঘাটে কয়েকটি স্টিমার ও লঞ্চ দেখতে পেলাম। আমরা চা-পান করে নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকায় করে গন্তব্য গোয়াইন ঘাট। নদী পুরোপুরি শান্ত। আকাশ দেখে মনে হয়েছে বৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। প্রায় ঘণ্টা খানেক হলো আমাদের বহনকারী নৌকা সুরমা নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। পাশ দিয়ে দু'একটি ট্রলার যাচ্ছিল নিজ নিজ গন্তব্যে। দূরে দেখা যাচ্ছিল আকাশভেদি পাহাড়। তার সঙ্গে দেখা যাচ্ছিল ঝর্নার পানি গড়িয়ে মাটিতে পরার দৃশ্য। কিন্তু বিরাট আফসোস! এই পাহাড় ও ঝর্নাগুলো ভারতের সীমান্তের ভেতর। তাই কাছে না গিয়ে দূর থেকে দেখতে হয়েছে। কী যে অপুরূপ সৌন্দর্যের মাঝে সময় কাটাচ্ছিলাম। নেই কোন ক্লান্তি, চিন্তা, ভয়, শাসন-বারণ। নদীর পানিতে শরীরখানা একবার ভেজানোর জন্যও মরুভূমি হয়ে ছিল বুকের উষ্ণ জমিনটুকু। এক পাশে নৌকা ভিড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম নদীর বুকে। হটাৎ করে আকাশ মেঘলা হয়ে এলো।
মেঘলা আকাশ! আমরা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলাম না। নৌকায় আবার সালুটিকর বাজার ফিরে এলাম। সুরমা নদীর বুকে থাকার সময় ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল, তবে ভয় পাইনি। সিলেট এমনই এই বৃষ্টি এই রোদ। সালুটিকর বাজার পৌঁছার পর পরই বৃষ্টি ঝড়ে রূপ নিলো। আমরা আশ্রয় নিলাম গ্রামের একটি বাড়িতে। সবগুলো ঘর মাটি দিয়ে তৈরি। বাড়ির চারিদিকে নানা রকমের গাছ-গাছালি। একটি ঘরের সামনে আমরা তালপাতার পাটি বিছিয়ে বসে পড়লাম। মনের আনন্দে গান করছিলাম। প্রচ- বাতাসে গাছগুলো দুলছিল, মনে হয়েছে গাছগুলো এখনই ভেঙে পড়বে। বাড়ির মানুষগুলো খুব ভালো, তাদের একজনকে বাজার করার টাকা দিয়ে বলেছিলাম আমাদের জন্য রান্না করার জন্য। ঘুরার নেশায় দুপুরে খাবারের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বৃষ্টির মুহূর্তে মাটির বাড়িতে আশ্রয় আমাদের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই ঠিক তখন পেটে দানা-পানি পড়ল। রাতে সিলেট শহরে ফিরে এলাম। পরের দিন কেটেছে সিলেট শহরেই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে। এক মুহূর্তে সময় হয়ে এলো প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যাওয়ার। অদেখা, অধরা, অজানা থেকে গেল অনেক কিছু। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে জানালা দিয়ে আরও একবার চোখ রাখলাম বাইরের দিকে। রাতের স্টেশনের পরিবেশ তখন খুব মায়াবী মনে হয়েছে। এক ঝলক টাটকা বাতাস যেন বয়ে গেল মনের উপর দিয়ে। ট্রেনের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল সিলেট রেল স্টেশন।
দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত (ঢাকা শুক্রবার, ৪ শ্রাবণ ১৪২০, ৯ রমজান ১৪৩৪, ১৯ জুলাই ২০১৩)

No comments:
Post a Comment