Wednesday, April 22, 2015

জোনাকি পোকার দেশে

রফিকুল ইসলাম সাগর
ঈদের দু'দিন পর মনে হচ্ছিল কোথাও যাওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ঈদই হবে না। আমার মন ঢাকায় আর এক মুহূর্তও থাকতে চাইছে না। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কোথায় যাওয়া যায় তার চিন্তা। রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসে সিদ্ধান্ত হলো আমার ফুপুর বাড়ি যাব – হরিয়াবহ গ্রাম। দুপুর সাড়ে বারোটায় ট্রেন। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে দশটা। দ্রুত বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়লাম। হাতে সময় খুব কম। এরই মধ্যে বন্ধুরা সবাই স্টেশনে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এদিকে তাড়াহুড়া, ওদিকে নির্বিকার রিক্সাচালক রিক্সা রাস্তার এক পাশে থামিয়ে একেকবার মোবাইল ফোনে কথা বলেই চলেছে। মহাখালী পর্যন্ত রিক্সায় গিয়ে তারপরে বাসে উঠলাম। ঈদের ছুটিতে ঢাকার পথ পুরো ফাঁকা ছিল। পথে গাড়ি আর মানুষ দুইয়েরই সংখ্যা বেশ কম। অন্য দিনের মত বাসের ভিতরে যাত্রীর চাপ নেই। খুব আরামেই অল্প সময়ে স্টেশনে পৌঁছালাম। মনে মনে ভাবলাম আমাদের ঢাকার রাস্তা যদি সব সময় এমন ফাঁকা থাকত।

আমি পৌঁছানোর পর বন্ধুরা নিশ্চিন্ত হলো। এবার ট্রেন আসার অপেক্ষা। ঠিক টাইম মত সাড়ে বারোটাতেই স্টেশনে ট্রেন এসেছে। ব্যাপারটা আমাদের অবাক করল। টাইম মত ট্রেন আসা তো বিশাল বড় ভাগ্যের ব্যাপার। খুশি মনে উঠে পড়লাম ট্রেনে, চলতেও শুরু করল। গন্তব্য আজমপুর। ঘোড়াশাল স্টেশনে গিয়ে থামল ট্রেন। কী ব্যাপার এই স্টেশনে তো ট্রেন থামার কথা না, বলল মনিম। পর্যবেক্ষণ করতে ট্রেন থেকে নেমে জানতে পারি অপরপ্রান্ত থেকে আরেকটি ট্রেন আসছে। এভাবে জিনারদী, রায়পুরা ও আশুগঞ্জ মিলিয়ে চারবার ট্রেন থামল। আড়াই ঘন্টার পথ আজমপুর পৌছাতে সময় লাগলো সাড়ে তিন ঘন্টা। যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে দেখা দৃশ্যগুলো খুব উপভোগ করেছি। ঘোড়াশাল ও ভৈরব দু'টি বড় ব্রিজ। রেলপথের দু'পাশের নদীগুলো বর্ষার পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। ট্রেন থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে একটি সিএনজি অটোরিক্সায় উঠে পড়লাম পাঁচ বন্ধুতে। গাড়ি চলল হরিয়াবহ গাঁয়ের পথের দিকে। 

হরিয়াবহ বলতে গেলে একেবারে অজপাড়াগাঁ। বিবাড়ীয়া জেলার কসবা থানার ছোট্ট একটি গ্রাম, কিন্তু সৌন্দর্যে অপরূপ। পাশেই ভারতের সীমান্ত। হরিয়াবহ গ্রামে এখনও পুরোপুরি বিদ্যুৎ পৌছায়নি। সরাসরি কোনও বাস যায়না। সড়ক পথে ঢাকা থেকে যেতে অনেক সময় লাগে তাই রেলপথ ব্যবহার করে অধিকাংশ মানুষ। এখানকার বেশিরভাগ পুরুষ চাকুরিজীবী। কিছু পুরুষেরা চাকরির জন্য ঢাকা নয়তো চট্টগ্রামে থাকেন। কেউবা পাড়ি জমিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। আর বাকিরা গ্রামে কৃষি কাজ করেন। বলা যায় এই গ্রামে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। পাহাড়ি এলাকা। হরিয়াবহ গ্রামের বিয়েতে এখনো পালকির প্রচলন রয়েছে। ইমামবাড়ি রেল স্টেশনের সামনে পালকি ভাড়া দেওয়া হয়। তবে দিনদিন পালকির কদর কমে যাচ্ছে। ছোটবেলায় অসংখ্য পালকি দেখতাম। তখন পালকি ছিল বিয়ের পর বউ নিয়ে যাওয়ার এক মাত্র মাধ্যম। এখন আর আগের মতো পালকি নেই।

চণ্ডিদার বাজার এসে অটো রিক্সা থামল। একে একে সবাই নেমে যার যার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাজারের মানুষগুলো আমাদের দিকে কেমন যেন অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। ঢাকা থেকে কেউ এলে বাজারের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ আমাদের প্রশ্ন করল আপনারা কোন বাড়িতে যাবেন? হরিয়াবহ গ্রামের পাশেই চণ্ডিদার সীমান্ত। চণ্ডিদার বাজারের ভেতর দিয়েই গ্রামে যাওয়ার পথ। পাশেই একটি প্রাইমারি স্কুল। অন্যপথে হাইস্কুল। প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে গাঁয়ে যাওয়ার রাস্তায় ঢুকলাম। কখনও সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে আঁকা-বাঁকা মাটির রাস্তা, কখনও পুকুরের পাশ দিয়ে। এভাবে অবশেষে পৌঁছলাম ফুফুর বাড়ি। খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাজারের দিকে গেলাম। বাজারে এখন অনেক দোকান হয়েছে, সবকিছুই পাওয়া যায়। নতুন একটি হাসপাতাল হয়েছে। এখানের মিষ্টি খুবই সুস্বাদু। কিন্তু চায়ের দোকানে চা খেয়ে স্বাদ পাওয়া যায় না। 'বরা' আর মিষ্টি বিকেলের নাস্তা করলাম। পিঁয়াজির মতো দেখতে ছোট ছোট তেলে ভাজা এক প্রকারের খাবার পাওয়া যায়, স্থানীয় নাম ‘বরা’, খেতে খুবই ভালো। ‘বরা’ বিক্রি হয় পাল্লা পাথর দিয়ে মেপে কেজি দরে। তারপর হাই স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকি। স্কুলটি অনেক বছরের পুরনো। হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে গিয়ে বড় একটি পুকুরের পাড়ে বসে খানিকক্ষণ মাছের লাফালাফি দেখলাম। 
এখানের মূল আকর্ষণ হলো সন্ধা ঘনিয়ে আসলেই লক্ষ লক্ষ জোনাকি পোকা পুরো গ্রামটিকে আলোকিত করে তোলে। তখন একটি গান খুব মনে পরে ‘জোনাকির আলো নিভে আর জ্বলে শাল মহুয়ার বনে’। সত্যি, এই একটি দৃশ্য আমাকে বারবার এই গ্রামে টেনে আনে। বন্ধুরা সবাই খুব অবাক হয় এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেয়ে। মনে পড়ে ছোট বেলায় এখানে বেড়াতে এলে জোনাকি পোকা ধরে বোতলের মধ্যে আটকিয়ে রাখতাম।

পরেরদিন সকালে নাস্তা সেরে আমরা গোসল করতে দারোগা বাড়ির পুকুর ঘাটে গেলাম। গ্রামের আরো অনেকেই এই পুকুর ঘাটে গোসল করতে এসেছে। দীর্ঘ সময় পুকুরে ডুব দিলাম, ভেসে থাকলাম, সাঁতার কাটলাম। তারপর চন্ডিদার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গেলাম। যাওয়ার পথে রাস্তার দু’পাশে অনেক কাঁঠাল গাছ চোখে পড়ল। বেশ উঁচু পাহাড়। সবগুলো পাহাড়ে কাঁঠালের বাগান। এ যেন কাঁঠালের দেশ। পাহাড়ের ওপর মাটির ঘরে মানুষের বসবাস।  ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি কাটা আছে। দূর দুরান্তে দেখা যায় উঁচু উঁচু পাহাড়, বড় বড় গাছ। যার বেশির ভাগ অংশ ভারতের সীমান্তের ভিতরে। আশেপাশের গ্রামগুলো খুব শান্ত চারিদিকে সবুজ ধান ক্ষেত, শাক সবজির বাগান। 
সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা ফেরার ট্রেন। পড়ন্ত বিকেলে গাঁয়ের সবুজ পরিবেশ চোখে নিয়ে আর বিশুদ্ধ বাতাস শরীরে লাগিয়ে অটো রিক্সায় চড়ে রেল স্টেশনের দিকে ফিরে চলা। গাছে গাছে পাখিদের কিচির মিচির। ফিরে যাচ্ছি বলে মনটা কেমন জানি আবেগী হয়ে গেল। ট্রেনে উঠলাম। তারপর আবার সেই ব্যস্ত শহর।

পেশায় সাংবাদিক রফিকুলের বাড়ি বাংলাদেশে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকার ফান ম্যাগাজিনে রম্য লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখির শুরু। বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক কার্টুন ম্যাগাজিন টুনস ম্যাগ বাংলা সম্পাদনা সহ বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় নিয়মিত কলম ধরেন। পাশাপাশি যুক্ত রয়েছেন নানান সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে। ভ্রমণ, আড্ডা ও ছবি তোলা তাঁর পছন্দের বিষয়।





No comments:

Post a Comment