রফিকুল ইসলাম সাগর
একজন মা যতো কষ্টেই থাকুক তিনি সব সময় তার সন্তানের সুখ কামনা করেন। সন্তান যতো বড়ই হোক মায়ের চিন্তার শেষ নেই। সকল আপদ-বিপদ, বাধা, ঝড়-তুফান সব কিছু থেকে সন্তানকে আগলে রাখেন যিনি তিনি আমাদের মা। নিজের সুখ সখ-আল্লাদ বলি দিয়ে আমাদের সুখের কথা চিন্তা করেন মা। পৃথিবীতে সন্তানের জন্য মায়ের ভালবাসা পুরোপুরি নিস্বার্থ। এই পৃথিবীতে এমন অনেক মা আছেন যারা সাংসারিক জীবনে সুখ পান না। আমাদের দেশের অনেক মা স্বামী ও শশুর বাড়ির লোকদের করা শত অত্যাচার নিশ্চুপ সহ্য করে যান সন্তানের মুখের দিক তাকিয়ে। ধৈর্য ধরেন, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক মিথ্যা অপবাদ সইয়ে যান নিরবে। এমন একজন মহান মায়ের গল্প জানাচ্ছি-
এই মা যে বাবা-মায়ের ঘরে জন্মেছেন তাদের খুব বেশি আদরের সন্তান ছিলেন। এতোটাই আদরের ছিলেন যে, তার সকল চাওয়া-পাওয়ার কথা মুখ ফেটে বলবার প্রয়োজন হয়নি কোনদিন তার আগেই সব কিছু সামনে হাজির করা হতো। তিনি জন্ম নেয়ার পূর্বে দশ বছর সন্তানহীন ছিলেন তার বাবা-মা। আর এ কারণেই আদরের কোনো কমতি ছিলনা। তার বাবা-মা তাকে লালন পালন করেছেন মাটিতে পা ফেলতে না দেয়ার মতো করে। যাকে বলে মাথায় তুলে রাখা। তার বাবার আর্থিক অবস্থাও খুব ভালো ছিল। গ্রামে একনামে তাদের বাড়ি পরিচিত। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন মেয়েকে। একপর্যায়ে পাশের বাড়ির এক মহিলার কথায় ঢাকার স্থানীয় এক ছেলের হাতে তুলে দেন আদরের মেয়েকে। ঢাকায় বিয়ে দেয়ার আগে বাবা ভাবেন, 'আমার মেয়ে শহরে লাইটের আলোয় থাকবে, ফ্যানের বাতাসে ঘুমাবে, আমাদের গ্রামে কারেন্ট নাই'। ছেলের ব্যাপারে খুব বেশি খোজ-খবর নেয়া হয়নি। শোনা কথায় ছেলের সম্পর্কে সবকিছু ভালোই তো মনে হয়েছে।
গ্রাম থেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শহরে আসা মা'টির নাম রাবেয়া (ছদ্দ নাম)। বাড়ির বড় বউ। শশুর বাড়ির সবাইকে আপন করে নেন প্রথম দিন থেকেই। বড় বাড়ির মেয়ে হলেও ছিলনা বিন্দুমাত্র অহঙ্কার। বাবার বাড়িতে কোনো কাজ করেননি কোনদিন। তাতে কি শশুর বাড়িতে এসে বসে থাকেননি। গুণবতী মেয়ে বলে কথা। একদিন জানলেন তার স্বামী সন্ত্রাস। সন্ত্রাসী নানান কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। স্বামীকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন বলে তার বিশ্বাস ছিল। নিজ বাবা-মায়ের কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখেন এই ভেবে যে, বাবা-মা জানলে কষ্ট পাবে চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারবেনা। একদিন দুইদিন করে এভাবে পেরিয়ে যায় অনেকদিন। কিন্তু স্বামীকে অন্ধকার পথ থেকে পারেননি ফিরিয়ে আনতে। পারবেনই বা কিভাবে শশুর-শ্বাশুড়ির তো এ পথ থেকে আনা টাকায় ভাত খেতে কোনো আপত্তি নেই। যাই হোক তার স্বামী একদিন আলোর পথে ফিরবেন এমন আশা বুকে নিয়ে চলছিল তার জীবন। একদিন তার কোল থেকে জন্ম নিলো ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান। নিষ্পাপ সন্তানের দিকে তাকিয়ে তার হতাশ মন খুঁজে পায় জীবনের নতুন মানে।
সন্তান জন্ম নেয়ার কয়েক মাসের মাথায় তার স্বামী এক অপরাধে পুলিশের কাছে ধরা পরে। জেল হয়। একপর্যায়ে তার বাবা মায়ের কাছে কোনো কিছু আর গোপন থাকেনা। মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও আসেন। কিন্তু তিনি স্বামীর সংসার ও সন্তান ছেড়ে বাবার সাথে যান না। জেলে যাওয়ার পর শশুর-শ্বাশুড়ির হাতে স্বামীর টাকা দেয়া বন্ধ হয়ে যায় তার পরই বেড়িয়ে আসে শশুর-শ্বাশুড়ির আসল রূপ। তারা শুরু করে খারাপ ব্যবহার। শুরু হয় তার উপর অমানবিক নির্যাতন। খাওয়া একবেলা জোটে তো আরেক বেলা জোটেনা। এতো কষ্টের পরেও বাবার বাড়ি ফিরে যাননি। শশুর-শ্বাশুড়ির অত্যাচারে কাজের লোকের মতো জীবন যাপন শুরু হয় তার। স্বামীর সাথে যে ঘরটিতে থাকতেন সেটি ভাড়া দিয়ে তাকে থাকতে দেয়া হয় রান্না ঘরে। একরাতে শিশু ছেলেটিকে নিয়ে রান্না ঘরের মেঝেতে ঘুমাচ্ছিলেন। রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। রান্না ঘরের চালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পরে মেঝে ভিজে যায়। সেই ভিজা মেঝেতেই শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়ে রাত পার করেছেন অসহায়ের মতো এই দুঃখিনী মা।
এভাবে চলতে চলতে একদিন গার্মেন্টসে কাজ নিলেন। একবছর পর তার স্বামী জেল থেকে ছাড়া পায়। ছাড়া পেয়ে বউ সন্তান নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। বউ সন্তান খেয়েছে কি না খেয়ে আছে সে নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই, নিজের খিদে মিটলেই হলো। এবার শুরু হয় স্বামীর শারীরিক মানসিক নির্যাতন। কোনো ব্যাপারে মুখ ফুটে প্রতিবাদ করলেই স্বামীর শারীরিক নির্যাতন। সাথে সঙ্গ দেয় শশুর-শ্বাশুড়ি। সন্তানের দিক তাকিয়ে সব সইয়ে যেতেন। বাবার বাড়ির দরজা খোলা থাকলেও যাননি। বাঙালী নারী বলে কথা। এভাবেই চলতে থাকে। দিন দিন অত্যাচার বাড়তে থাকে। দেখতে দেখতে ছেলেও বড় হয়ে যায়। একদিন ছেলে ভাত খেতে চায়। ঘরে আছে শুধু পানিভাত। তা লবন দিয়ে মাখিয়ে ছেলেকে খেতে দেয়। ছেলে বলে, মা আমাকে একটা পেয়াজ দাওনা মাখিয়ে খাই'। মা উত্তর দেয়, বাবা এমনেই খেয়ে নাও ঘরে পেয়াজ নেই। স্বামী বলে, পাশের ঘর থেইকা আইন্না দে পেয়াজ। মা উত্তর দেয়, রোজ রোজ আমি পারবোনা....ব্যাস এ কথা বলতেই তার উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়। শুধু তাই নয় সেদিন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। তিনি তার ছেলেকে সাথে নিয়ে যেতে চান! কিন্তু পারেননা।
বাবা-মার কাছে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ছেলের চিন্তায় একটি রাতও ঘুমাতে পারেননা। বাড়ী থাকলেও মন পরে থাকতো ছেলের কাছে। প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেকে দেখতে আসেন। যেভাবেই হোক ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে তার সব চেষ্টা শুরু করেন। বাবা-মা তাকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার জন্য জোর করতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি কোনভাবেই রাজি হননি। বছর দুয়েক যেতে এক পর্যায়ে বাবা তাকে জোর করে আবার বিয়ে দিয়ে দিবেই। বিয়ের আসর থেকে তিনি পালিয়ে থাকা চলে আসেন। গার্মেন্টসে কাজ নেন। তখন ছেলে স্কুলে পড়ে। ছেলেকে দেখতে স্কুলের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতেন। ডেকে নিয়ে এটা সেটা কিনে দিতেন। শ্বশুর বাড়িতে একদিন যখন জানতে পারলেন তিনি স্কুলের সামনে ছেলের সাথে দেখা করেন ছেলের স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আজ অনেক বছর পেরিয়েছে। এই মায়ের ছেলের বয়স ২৬বছর। এখনো তিনি নতুন করে সংসার করেননি। ছেলে বড় হয়েছে। সব কিছু বুঝে। মায়ের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। কিন্তু ছেলেকে তার মতো করে মানুষ করতে পারেননি বলে তার দুঃখ হয়।
চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন সবুজের মেলার ৩০তম সংখ্যায় প্রকাশিত

No comments:
Post a Comment