রফিকুল ইসলাম সাগর
আমি মালয়েশিয়ার প্রায় প্রতিটি দর্শনীয় স্থান ঘুরেছি। এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত গিয়েছি। বলা যায় মালয়েশিয়ার পর্যটন আকর্ষনীয় যত জায়গা আছে সব স্থানে গিয়েছি। কখনো বিমানে, কখনো বাসে কখনো বা জাহাজে। সেখানকার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভালো খারাপ মিলিয়ে নানান রকমের মানুষের সাথে মিশেছি, কথা বলেছি, দিন যাপন করেছি। হয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা। বাস্তব জীবন যে কত কঠিন তা আমি মালয়েশিয়া না আসলে বুঝতে পারতাম না। আমার পুরো জীবনটাই পাল্টে গিয়েছে, শিখেছি অনেক কিছু। একটা কথা বলতেই হয় আমাদের দেশে আমাদের বাবা-মা আমাদের যেমন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ায় প্রবাসে এমনটি হয় না। সেখানে সবাইকে পরিশ্রম করে চলতে হয়। কিছু কিছু দিক বিবেচনা করলে আমাদের সোনার বাংলাদেশ কথায় না কাজেও সোনার বাংলাদেশ।
মালয়েশিয়ার গোটা দেশ জুড়ে পাহাড়। এশিয়ার একটি দেশ হলেও কিছু কিছু জায়গায় গেলে মনে হয় ইউরোপের কোনো দেশ। যেমন বুকিট বিনতাং, গ্যান্তিং হাইল্যান্ড ও লাংকাউই। মালয়েশিয়ানদের সবচেয়ে প্রিয় ঘুরে বেড়ানো,শপিং করা ও সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। বন্ধের দিন অথবা কাজ শেষ করে নিজ গাড়িতে করে তারা ঘুরতে চলে যায় নিজ গ্রামে অথবা দূরে কোথাও। মালয়েশিয়ায় জিরো ডাউনপেমেন্টে ও দীর্ঘমেয়াদী সহজ কিস্তিতে গাড়ি কেনা যায় বলে সবার গাড়ি এবং মটর সাইকেল আছে। এখানকার মটর সাইকেল দেখতে আমাদের দেশের মটর সাইকেলের মত না। দেখতে আমাদের দেশে চলিত লেডিস স্কুটির মত। মটর সাইকেল গুলোর গতি ১০০ সিসি থেকে ১৫০০ সিসি পর্যন্ত। অবাক লাগে যখন দেখি বৃদ্ধ বয়সের নারী মটর সাইকেল অথবা সাইকেল চালাচ্ছেন। আমাদের দেশের নানী দাদী বয়সের নারীরাও কঠিন পরিশ্রম করে। প্রতিটি সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নারীদের সংখ্যাই বেশি। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কোটা থাকায় প্রতিটি সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যাও চোখে পড়ার মত। এছাড়া প্রতিবন্ধীরা সরকার থেকে আর্থিক সহযোগিতা সহ নানান রকমের সুযোগ-সুবিধা পায়। মালয়েশিয়ানরা নিজ ঘরে রান্না করে খাওয়ার চেয়ে বাইরে রেস্টুরেন্টেই খাবার খায় বেশি। বেশির ভাগ মানুষ তিন বেলা বাইরে থেকে খাবার কিনে খায়। তাই এখানকার সব চেয়ে লাভজনক ব্যবসা খাবারের ব্যবসা। মালয়েশিয়ার অলিতে গলিতে খাবারের দোকান/রেস্টুরেন্ট। কাজ শেষে নারী পুরুষ উভয়কে মধ্যরাত পর্যন্ত খাবারের দোকান গুলোতে আড্ডা দিতে দেখা যায়। অধিকাংশ খাবারের দোকান ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। সব গুলো খাবার দোকান/রেস্টুরেন্টে প্রজেক্টর নয়তো বড় পর্দার টিভি আছে। ফুটবল এদেশের মানুষের সব চেয়ে প্রিয় খেলা। ক্রিকেট খেলার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ফুটবলের বড় বড় ম্যাচ গুলোতে খাবারের দোকান/রেস্টুরেন্টে সবচেয়ে বেশি ভীর থাকে। প্রজেক্টর অথবা বড় পর্দার টিভিতে তারা খেলা দেখে হই চৈ করে। সাথে কেউ কেউ আতশ বাজি করে,পটকা ফুটায়।
শপিংমলের সংখ্যা মালয়েশিয়ায় অনেক। শুধু ছুটির দিন নয় সপ্তাহের প্রতিটিদিন শপিংমলে ভীর থাকে। প্রতিটি শপিংমলে সিনেমা হল আছে। মালয়েশিয়ানরা মালাই সিনেমার চেয়ে ইংলিশ সিনেমাই দেখে বেশি। তারা মূলত ভুতের সিনেমা, এনিম্যাশন সিনেমা বেশি পছন্দ করে। এছাড়া তারা হিন্দী সিনেমাও দেখে। তবে তারা হিন্দী খুব একটা বুঝে না। ইংলিশ সাবটাইটেল দেখে বুঝে নেয়। অনেকের মুখে হিন্দী গান শুনি। বিশেষ করে শাহরূখ খানের সিনেমার গান। শাহরূখ খান তাদের অনেক পছন্দের নায়ক। মালাই সিনেমা গুলো বেশিরভাগই ভুতের কাহিনী। এছাড়া প্রেমের সিনেমা ও কমেডি সিনেমাও নির্মাণ হয়। তবে ভুতের সিনেমাই বেশি জনপ্রিয়। তাদের মিডিয়া খুব একটা উন্নত না। নাটক, সিনেমা, সংবাদ কোনো কিছুরই খুব বেশি সুনাম নেই। মালয়েশিয়ার মিডিয়ার চেয়ে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনের মিডিয়া উন্নত। মালয়েশিয়ানদের দাবি তাদের সিনেমায় খুব বেশি টাকা খরচ করা হয় না যেই কারণে তাদের সিনেমা ভালো হয় না। প্রায় বছর খানেক আগে মালয়েশিয়ার যেই বাড়িটিতে থাকি তার সামনের প্রধান সড়কে দুই সন্ত্রাসীকে পুলিশ গুলি করে মেরেছিল। তাদের কাছ থেকে স্নাইপার নামক একটি পিস্তল পাওয়া গিয়েছিল বলে সাথে সাথে গুলি করা হয়। দুই সন্ত্রাসী মারা যায়। ক`য়েক মিনিটে আরো অনেক পুলিশের গাড়ি এসে রাস্তাটি ব্লক করে দেয়। হই চৈ শুনে রাস্তায় বের হয়ে দেখতে পাই নতুন এই দৃশ্য। কিন্তু কাছে যাওয়ার কারো অনুমুতি নেই। পুলিশ লাইন লেখা সীমানার বাইরে দাড়িয়ে সবাই এই দৃশ্য দেখছে। লাশ দেখতে পাইনি। শুধু দূর থেকে দেখেছিলাম একটি সাদা গাড়ি যেই গাড়িটির ভিতরেই দুই সন্ত্রাসীকে গুলি করা হয়েছে। সেখানে অনেক পুলিশ। সাংবাদিকরাও সংবাদ সংগ্রহ করতে এসে আমাদের সাথে দাড়িয়ে ছিল। তাদেরও কাছে যাওয়ার অনুমুতি নেই। দূর থেকে দাড়িয়ে সাংবাদিকরা ছবি তুলছিল ভিডিও চিত্র ধারণ করছিল। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির লাশের ছবি ও ভিডিও চিত্র মালয়েশিয়ার মিডিয়াতে প্রকাশ হয় না। শুধু সংবাদ প্রকাশ হয়। টিভিতে সংবাদে যে ভিডিও চিত্রটি দেখানো হয়েছিল সেখানে পুলিশ আর পুলিশের গাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখিনি।
মালয়শিয়ার আইন কঠিন তারপরেও এখানে অপরাধ হয় না বললে ভুল হবে। তবে ভয়ংকর রকমের অপরাধ যেমন- মানুষ হত্যা হয় না বললেই চলে। ছিনতাই চুরির ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। কিছু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ মহল্লা আছে যেখানে চলতি পথে সতর্ক থাকতে হবে। মটর সাইকেলে করে চলতি পথে স্বর্ণের চেইন হাতে থাকা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় হেলমেট পরা ছিনতাইকারীরা। ছিনিয়ে নেয়ারপর মটর সাইকেলের গতি বাড়িয়ে চলে যায়। কখনো কখনো চলতি পথে একা পেলে মটর সাইকেল থামিয়েও সব কিছু কেড়ে নেয়। তারা অস্র হিসেবে ব্যবহার করে ছুরি-চাকু। ছিনতাই করার জন্য ছিনতাইকারী টার্গেট করে মূলত বিদেশীদের। কারণ মালয়েশিয়ানদের নিকট থেকে ছিনতাই করলে ধরা পরতেই হবে। মালয়েশিয়ানরা এমন ঘটনার পর পুলিশের কাছে অভিযোগ করে, আর অভিযোগ করলে অপরাধীকে পুলিশ খুঁজে বের করবেই। কিন্তু বিদেশীরা কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না 'যা যাওয়ার তা গেছে এমন ভাবে'। বিদেশীদের মধ্যে বাংলাদেশী, নেপালী ও মায়ানমারীদের টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা। কখনো তারা বিদেশীদের ঘরে ঢুকেও চুরি করে। বিদেশী হিসেবে বাংলাদেশীরা এইসব ঘটনার সম্মুখীন হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করে কোনো বিচার পায় না। উল্টো পুলিশের কাছে গেলে পাসপোর্ট ভিসা ঠিক আছে নাকি চেক করার ভয়। ছিনতাই চুরি এই কাজ গুলো করে মূলত তামিল ও ইন্দোনেশিয়ানরা। এখানে অধিকাংশ তামিলরা জন্মসুত্রে মালয়েশিয়ান। মালয়েশিয়া অপরাধ কর্মকান্ডের সাথে তারাই সবচেয়ে বেশি জড়িত। তামিল যারা ভালো তারা অনেক ভালো। এছাড়া নাইজেরিয়ান, লিবিয়ান, আফ্গানিস্থানী ও পাকিস্থানীরা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত।
চায়না টাউন নতুন-পুরাতন পণ্য কেনা বেচার জন্য মালয়েশিয়ার অতি জনপ্রিয় মার্কেট/বাজার। অনেক বাঙালি একে পাপী পাড়াও বলে থাকেন (এখানে বৈধ-অবৈধ সব কিছু পাওয়া যায় বলে)। চায়না টাউন আমাদের দেশের গুলিস্থান। পুরো বিশ্বে পরিচিত চায়না টাউনে দেশী ক্রেতার চেয়ে বিদেশী ক্রেতার সংখ্যাই বেশি। সকাল দশটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কেনা-বেচা চলে। বেশিরভাগ দোকান সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়। ইউরোপিয়ান পর্যটকদের আনা গোনা দেখা যায় বেশি। সবচেয়ে কম মূল্যে নতুন-পুরাতন পণ্য কেনা-বেচা হয় এখানে। চায়না টাউনে দোকান গুলো সব ছোট ছোট। এক দোকানের সামনে আরেক দোকান। পোশাক,ব্যাগ,জুতা,শো-পিছ,হাত ঘড়ি,খেলনা ম্যাসাজ সেন্টার সহ আছে সব। প্রয়োজনীয় সব কিছু খুব কম মূল্যে পাওয়া যায়। হয়ত এই কারণেই বিদেশীদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। তবে চায়না টাউনে দামদর করে কিনতে হবে। একটি হাত ঘড়ির দাম চাইবে ২০০ রিঙ্গিত সাহস করে আপনি ২৫ রিঙ্গিত বললে বিক্রেতা কিছুক্ষণ মুলামুলি করে এই দামেই বিক্রি করবে যদি আপনি আরো বেশি দাম না বলেন। চায়না টাউনে অসংখ্য বাঙালি কাজ করে। বলা যায় চায়না টাউন প্রবেশ করলে প্রায় সব দোকানেই বাঙালি। কেউ কেউ নিজেও দোকান বসিয়েছেন। চায়না টাউনে যে সব বাঙালি কাজ করেন তারা খুব ভালই আছেন। বেতন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট। তবে চায়না টাউন পুলিশী ঝামেলা বেশি। সারাদিন পুলিশের আনাগোনা থাকে। ধরপাকর হয় ব্যাপক। অনেক দোকান অবৈধ তাই পুলিশের আগমনে কিছু কিছু দোকানপাট সরিয়ে ফেলতে দেখা যায়। পুলিশ চলে গেলে সব কিছু আগের মত।
মালয়েশিয়াতে যত ভিক্ষুক দেখেছি ১০০ ভাগের মধ্যে ৯০ ভাগ ভিক্ষুক দেখেছি যারা সরাসরি হাত পেতে ভিক্ষা নেয় না। ভিক্ষা নেয় শারীরিক পরিশ্রম করে। এই যেমন চার-পাচ জনের ভিক্ষুক দল সড়কে নানান ধরনের বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে মানুষকে বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করছে। কেউ দল ছাড়া একা বাদ্য যন্ত্র বাজাচ্ছে। কোথাও কোথাও বাদ্য যন্ত্রের সাথে গানও গাইছে। দর্শনার্থীরা যার যত ইচ্ছা খুশি হয়ে তাদের টাকা দিচ্ছে। কোনো কোনো ভিক্ষুক টিস্যু বিক্রি করছে।
লেখা ও ছবি: রফিকুল ইসলাম সাগর
২১ আগস্ট ২০১৩, দৈনিক বর্তমানে প্রকাশিত

No comments:
Post a Comment